কবিতার খাতা
কালো মেয়ের জন্যে পংক্তিমালা – শামসুর রাহমান
আমার নামধাম তোমার জানার দরকার নেই, কালো মেয়ে।
আমি শাদা কি কালো, হলদে কি বাদামি,
সবুজ কি বেগুনি
তাতে কী এসে যায়? ধ’রে নাও, আমার কোনো বর্ণ নেই,
আমি গোত্রহীন। বলা যায়, আমি শুধু একটি কণ্ঠস্বর,
যা মিশে থাকে ঘন কালো অরণ্যের লতাপাতায়,
ঝিলের টোল-খাওয়া পানিতে হরিণের মুখ রাখার ভঙ্গিমায়,
উটের গলার ঘণ্টাধ্বনিতে। এই কণ্ঠস্বর বয়ে যায় বিষুব রেখায়,
উত্তর মেরুতে, বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গে তরঙ্গে
আর আফ্রিকার অজস্র জেব্রার খুরধ্বনিময় প্রান্তরে।
কালো মেয়ে, তুমি যতই কালো হও,
তোমার সত্তায় আমি দেখেছি
গীর্জার মোমবাতির আলোর মতো আভা,
সে আভাকে প্রণতি জানায় এই কণ্ঠস্বর।
তুমি যখন প্রথম চোখ মিলেছিলে,
কালো মেয়ে, স্বপ্নালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিলো একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত, সে-হাত কালো,
তোমার জন্য রুটি বানিয়েছিল যে-হাত, সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল তুলে দিয়েছিল
যে-হাত বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।
কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্রের গহ্বরে হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে লাঞ্ছনার
অট্টহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ পেরিয়ে
গায়ে উপহাসের কাদা মেখে, গা ঝারা দিয়ে
জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চুড়ায়।
তোমার বর কে ওরা ঘরছাড়া করেছে,
ওর কালো মখমলের মতো কণ্ঠস্বর ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে,
তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত হবে না তার তারা-ঝলসিত গান।
কিন্তু, কালো মেয়ে, তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।
যেদিন তোমার দু’জনের সন্তান ওর অস্তিত্ব ঘোষণা করবে প্রথমবার,
সেদিন সূর্যোদয় গালিচা বিছিয়ে দেবে তার উদ্দেশে,
গান গেয়ে উঠবে রঙবেরঙের পাখি, গাছাপালা করতালিতে মুখর ক’রে তুলবে দশদিক।
তোমার কোল-আলো-করা ছেলে বেড়ে উঠবে
শত্রুর বন্দুকের ছায়ায় বছরের পর বছর, রাত গভীর হ’লে স্বাধীনতার
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে স্যাক্সফোনে সে তুলবে তোমার পূর্বপুরুষদের যন্ত্রণার সুর;
তোমার ক্রুশবিদ্ধ মর্যাদার ক্ষতগুলো ধুয়ে সেখানে ফোটাবে সে প্রসন্ন অর্কিড,
সে তার জোরালো কালো হাতে মুছিয়ে দেবে আফ্রিকার কালো হীরের মতো চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া অশ্রুজল।