কসম- আবদুল হাই শিকদার।

কবিতা “কসম” – আবদুল হাই শিকদার বিশ্লেষণ

আবদুল হাই শিকদারের “কসম” কবিতাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এক শক্তিশালী কবিতা। কবি এখানে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।

কবিতার সারাংশ

এই কবিতায় কবি তার পিতামাতা, গ্রাম, প্রিয় নারী, মাতৃভূমি, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার চেতনাকে কোনোভাবেই বদলাতে না পারার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে অটল থাকার শপথ নিয়েছেন।

রূপক বিশ্লেষণ

কবিতাটিতে “সিরাতুল মুসতাকিম”, “কোরআন, বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক”, “শস্যক্ষেত্র”, “নিসর্গ”, “নিলাকাশ” ইত্যাদি মাধ্যমে পবিত্রতা ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসার রূপক ফুটে উঠেছে। “মাকড়সার জাল” ও “ড্রাকুলা” দিয়ে শোষক ও হিংস্র শক্তিকে বোঝানো হয়েছে।

কবির উদ্দেশ্য

কবি আবদুল হাই শিকদার বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি বিদেশি প্রভাব ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

আবেগ বিশ্লেষণ

কবিতাটিতে দেশপ্রেম, আত্মপরিচয়ের অহংকার, শোক, ক্ষোভ ও সংকল্পের গভীর আবেগ বিদ্যমান। কবির ভাষায় শপথের দৃঢ়তা ও অঙ্গীকারের জোরালো প্রকাশ লক্ষণীয়।

মেটা ডেসক্রিপশন

আবদুল হাই শিকদারের “কসম” কবিতার বিশ্লেষণ। কবিতার রূপক, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা চেতনা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিফলন নিয়ে আলোচনা।

FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)

কবিতাটির মূল বিষয় কী?

মূল বিষয় হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতি অটল থাকার শপথ।

কবিতাটি কোন প্রসঙ্গে লেখা?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত।

© Kobitarkhata.com – কবি: আবদুল হাই শিকদার

আমি সিরাতুল মুসতাকিমের ভাষায
বলছি
আমি কোরআন, বেদ, বাইবেল ,
ত্রিপিটকের উপর হাত রেখে বলছি,
আমি আমাদের শস্যক্ষেত্র, নিসর্গ
নিলাকাশের নামে বলছি,
আমি উত্তরের একলা নদী দুধকুমারকে স্পর্শ
করে, বলছি,
আমি আমাদের মহান পূর্বপূরুষদের ত্যাগ ও
সংগ্রামের শপথ করে বলছি
আমি আমার সকল সামর্থকে একত্র করে
বলছি,
আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতার নাম আমি
বদলাতে পারবো না।
আমার মমতাময়ী মায়ের নাম আমি
বদলাতে পারবো না।
আমার শৈশবের গ্রামের নাম আমি
বদলাতে পারব না।
আমার প্রিয়তম নারীর নাম আমি
বদলাতে পারব না।

আমার শীশুর তুলতুলে গাল আমি বদলাতে
পারবো না।
যারা আমার মার্তৃভূমিকে ব্যর্থ ও
অকার্যকর করার জন্য বিছিয়েছে
মাকড়সার জাল,
যারা পিটিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা
করেছে,
যারা ক্ষত-বিক্ষত লাশের উপর হিংস্র
উল্লাসে বর্বর নৃত্য করেছে,
যারা ড্রাকুলার মত পান করেছে
মানুষের রক্ত,
বিশ্বময় পাঠিয়েছে ভুল ও বিভতস
বার্তা,
তাদের কথায় আমি বদলাতে পারি না।

আমি উত্তরের ভাওয়াইয়ার গানকে
বদলাতে পারবো না।
জালালের ভাটিয়ালি গানকে
বদলাতে পারবো না।
লালনের একতারা বদলাতে পারবো
না।
হাছন রাজার নেশার ঘোর আমি
বদলাতে পারবো না।
আমি আব্বাস উদ্দিনের বদলে আদভানিকে
ভালোবাসতে পারবো না।
আমি পাগলা কানাইয়ের বদলে পবন
দাশকে নিতে পারবো না।
আমি মায়ের বদলে মাসি কিনতে
পারবো না।
আমি হীরার বদলে কাঁচ কুড়াতে
পারবো না।
আমি দাদীকে দিদা বলতে পারবো
না।
আমি পানির বদলে জলপান করতে
পারবো না।
আমি কপোতাক্ষের বদলে ময়ূরাক্ষীকে
আপন করতে পারবো না
আমি লালবাগের দূর্গের বদলে ফোর্ট
ইউলিয়ামকে নিতে পারবো না।
আমি ষাটগুম্বুজের বদলে ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়াল নিতে পারবো না।
আমি পল্টনের বদলে গড়ের মাঠ নিতে
পারবো না।
আমি প্রবীর মিত্রের বদলে
প্রসেনজিতকে নিতে পারবো না।
আমি ভাই গিরিশ সেনের বদলে
গয়াকাশি নিতে পারবো না।
আমি নজরুরের বদলে নরেন্দ্র মোদীকে
নিতে পারবো না।

আমি শেরে বাংলার বদলে মহাত্মা
গান্ধিকে নিতে পারবো না।
আমি ভাসানীর বদলে ভক্ত প্রহল্লাদ
সাজতে পারবো না।
আমি হোসেনী দালানের বদলে
হাওড়া ব্রিজ দেখতে পারবো না।
আমি সোনারগাঁয়ের বদলে
সোনাগাছি যেতে পারবো না।

শরীয়ুতুল্লাহর বদলে শিয়ালদা, কিছুতেই
নয়।
শমশের গাজীর বদলে শরীর, কিছুতেই নয়।
শাহজালালের বদলে শবরমতী কিছুতেই
নয়।
রমনার বদলে রাজঘাট কিছুতেই নয়।
কুমিল্লার বদলে কলকাতা নিতে
পারবো না।
আমি ঢাকার বদলে দিল্লিকে প্রণাম
করতে পারবো না।
আমি ”পদ্মা, মেঘনা, যমুনার” বদলে ”সেই
সময়” নিতে পারবো না।

আমি আবু জাফর শামশুদ্দিনের বদলে
সুনীলকে নিতে পারবো না।
আমি বিষাদ সিন্ধুর বদলে সুধা সিন্ধু
নিতে পারবো না।
আমি মৈমনসিংহ গীতিকার বদলে
গাদ্দার নিতে পারবো না।
আমি দীনেশ সেনের বদলে মূর্তিমান
প্রলোভন নিতে পারবো না।
আমি শালগাছের বদলে শালা
বানচোতদের নিতে পারবো না।

আমি সুন্দরবনের বদলে সুমুন্ধির পুতকে বুকে
নিতে পারবো না।
আমি “ দাবায়ে রাখতে পারবা না”র
বদলে “ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা”
বলতে পারবো না।
আমি স্বাধীনতার ঘোষকের বদলে
আদালত পাড়ার দৈ বড়া খেতে পারবো
না।

আমি পরিস্কারভাবে বলছি,
আমি সকল পবিত্রতার অঙ্গ হয়ে বলছি,
আমি কাজলরেখার বদলে রেখাকে
নিযে ঘর বাঁধতে পারবো না।
আমাদের ঐতিহ্যকে ফেলে ঐশ্বরিয়া
রায়ের পাশে দাঁড়াতে পারবো না।
যারা আমার পদ্মাকে শুষ্কো বালুতে
পরিনত করেছে,
যারা টিপায়মুখ দিয়ে আমার
কল্লোলিনী মেঘনাকে হত্যা করতে
চাচ্ছে,
যারা আমার তারুণ্যকে মাদকাসক্ত
করেছে,
যারা আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে
দিয়েছে নৃশংস শান্তিবাহিনী,
যারা আমার হৃদয়কে করেছে বিভেদ ও
হানাহানিতে নিক্ষেপ,
যারা আমার ভাইকে করেছে আমার
ভাইয়ের ঘাতক,
যারা আমার ডান হাতকে লাগিয়েছে
বাম হাতের বিরুদ্ধে,
-তাদের কথায় আমি বদলে যেতে পারি
না।
আমি আমার লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা
নিশানকে ধুলোয় গড়াতে দিতে পারি
না।
আমি আমার শহীদ ভাইদের রক্ত চিহ্ন
ফেলে শ্বাপদ সন্কুল পথে যেতে পারি
না।
আমি আমার স্বাধীনতার বদলে সোনার
শিকল গলায় পরতে পারি না।
আমি আমার সেনাবাহিনীকে ভাড়া
খাটা বেশ্যায় পরিণত করতে পারি
না।

আমি অভিশপ্ত ইসরাইলকেকে স্বীকৃতি
দিতে পারি না।
আমি ওয়াশিংটনের মাস্তানির নিচে
মাথা পেতে দিতে পারি না।
আমি তেলআবিবের টাকায়
মানবাধিকার পাচার করতে পারি
না।
আমি আমেরিকাকে আল্লাহর উপর স্থান
দিতে পারি না।

যারা আমার বি.ডি.আরকে ধ্বংস
করেছে,
যারা আমার সেনাবাহিনীকে হত্যা
করেছে পিলখানায়,
যারা আমার ভাইদের হত্যা করছে
প্রতিদিন সীমান্তে,
যারা আমার মাথার ভিতরে তৈরী
করেছে কালচারাল কলোনি,
যারা আমার স্বাধীন মানচিত্রকে
করেছে অরক্ষিত,
যারা ন্যায় ও সত্যকে হত্যা করছে
প্রতিদিন,
যারা আমার রাত্রির আকাশকে করেছে
চাঁদশূন্য,
যারা সূর্যের মুখে ছিটিয়েছে
নোংরা বর্জ্য,
যারা আমার জীবন থেকে উধাও করেছে
নিরাপত্তা,
যারা আমাদের নিক্ষেপ করেছে
অশ্রদ্ধা ও অসহিহুতায়,
যারা আমাদের প্রতিটি সূযোদয়কে
করেছে অস্থির ও টালমাটাল-
কসম পলাশীর আম্রকাননের,
কসম ঈশা খাঁর সমরজয়ী অমর তরবারীর,
-কসম আল্লাহর, তাদের কথায় আমরা বদলে
যেতে পারি না।

আমি মঙ্গাপিড়িত ধরলার ক্ষুধার্ত রোদন
ধ্বনীর শপথ করে বলছি,
আমি দক্ষিনে আছড়ে পড়া ক্ষুব্ধ সমুদ্রের
গর্জনের কসম খেয়ে বলছি,
আমি মেঘনা প্রতিটি ঢেউয়ের দোলকে
বক্ষে ধারণ করে বলছি,
যারা আমাদের বদলাতে চায়, আমরা
তাদের বদলে দিব।

মীরজাফর বিভীষণকে বানাবো মীর
মর্দন কিম্বা মেঘনাদ।
শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রয়কারিদের
দেনা শোধ করে,
এই মৃত্তিকায় ফিরিয়ে আনবো,- এই
মায়ের পায়ের কাছে।
তারপর বলবো, কেন তুমি আধিপত্যবাদের
কাছে হৃদয় বন্ধক দিয়েছিলে?
তারপর বলবো, কেন তুমি খ্যাতি ও
প্রতিপত্তির লোভী?
তারপর বলবো, কেন তুমি সিংহাসন ও
সিংহাসন?
দ্যাখো এই মাটি আমার মায়ের পবিত্র
জায়নামায।

দ্যাখো এই মাটি আমাদেও
প্রপিতামহদের ত্যাগের কথা বলে।
দ্যাখো এই মাটি তীতুমীরের মত
টকটকে লাল।
এবার বলো কেন তুমি তোমার ভাইকে
সাম্প্রদায়িক বলেছো?
এবার বলো কেন তুমি সমঝোতা ও
সম্প্রীতির বদলে
ঘৃনা এবং হানাহানিকে মোক্ষ জ্ঞান
করছো?

এবার বলো কেন তুমি তোমার মাকে
কালিমা মলিন করেছো?
তারপর আমারা আমাদের সম্মিলিত পাপ
যমুনা জলে বিসর্জন দেব।
ঘৃনায় ক্ষোভে যমুনা প্রত্যাখ্যান করলে,
এই পাপকে আমরা পাঠাব মৃত্তিকার
গহ্ববরে,
লাঞ্চিত মৃত্তিকা বমির মত উগরে দিলে,
নক্ষত্রলোক থেকে এই পাপ নামিয়ে
আনবো ধুলিতে।
তারপর এই পাপ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের
বাইরে পাঠাবো।

তারপর এই পাপ বস্তাবন্দি করো
পাঠিয়ে দেব আধিপত্যবাদের উঠানে।
তারপর বলবো এই পাপ ধারন করার জন্য
আমার মাতৃভূমি প্রস্তুত নয়।
কসম সালাম বরকত রফিক জব্বারের,
কসম ১৯৭১ সালের,
কসম কর্ণফুলীর তীরে অপেক্ষামান
আমাদের ভবিষ্যতের,
কসম শাহজালালের আজান ধ্বনীর,
কসম আমার মন্দির মসজিদ গির্জা
প্যাগোডার,
কসম লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রতি ফোঠা
রক্তের,
কসম কসম কসম আমরা এইসব করবো।

তারপর পানিতে ধুয়ে নেব মাতৃভূমির
শ্রান্ত ক্লান্ত ব্যথিত শরীর।

আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। আবদুল হাই শিকদার।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x