কবর – পল্লীকবি জসিমউদ্দীন

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।

বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না¬ হেস না¬ শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।

তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।

এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!

তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।

ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল¬ আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু¬ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকি¬মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!

এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ¬বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।

ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বু¬জীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়।

হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।

একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধর¬ধর¬ বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুম¬ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু¬ব্যথিত প্রাণ।

কবর – পল্লীকবি জসিমউদ্দীন | হৃদয়বিদারক বাস্তবতায় বাংলা কবিতার এক মর্মস্পর্শী ছবি

“কবর”পল্লীকবি জসিমউদ্দীন-এর এক অসামান্য সৃষ্টি, যেখানে বাঙালি গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের নিগূঢ় দুঃখবোধ প্রতিফলিত হয়েছে। কবিতার প্রথম লাইন, “এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে” শুরুর সাথে সাথেই পাঠক প্রবেশ করেন এক গভীর আবেগঘন বৃত্তে, যেখানে একটি বৃদ্ধ দাদু তার নাতিকে গ্রামের কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে স্মৃতির সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

এই কবিতায় “মাটি” শুধু মৃতদেহের শেষ আশ্রয় নয়; এটি হয়ে ওঠে সম্পর্কের, ভালোবাসার, অপূরণীয় বেদনার এক প্রতীক। একেকটি কবর একেকটি জীবনের গল্প বহন করে—দাদি, বাপ, মা, ফুফু, বোন—প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে আছে অশ্রু, আছে ত্যাগ, আছে অতল বেদনা।

জসিমউদ্দীন এই কবিতায় যেভাবে গ্রামীণ বাংলার ভাষা ও আবেগ ব্যবহার করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। “পুঁতির মালা”, “তামাক মাজন”, “লাঙল-জোয়াল”, “জোনাকির আলো”, “ঘুঘুর কান্না”—এইসব উপমা আমাদের এক বাস্তব ও জীবন্ত পরিবেশে নিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি কবর যেন কাঁদতে কাঁদতে গল্প বলছে।

SEO প্রেক্ষাপটে এই কবিতার বিবরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। Google কিংবা Bing এর মত সার্চ ইঞ্জিনের জন্য এই কনটেন্টে যুক্ত করা হয়েছে প্রাসঙ্গিক কীওয়ার্ড যেমন: “কবর কবিতা বিশ্লেষণ”, “পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ কবিতা”, “গ্রামীণ বাংলা ও মৃত্যু”, “বাংলা হৃদয়ছোঁয়া কবিতা”, “জসিমউদ্দীনের কবর কবিতার সারাংশ”, “মাটির প্রতি ভালোবাসা কবিতায়”, “বাংলা আবেগঘন কবিতা বিশ্লেষণ” ইত্যাদি।

“কবর” কবিতায় প্রতিটি স্তবক যেন মৃত্যুর চেয়ে গভীর জীবনের কথা বলে। দাদুর মুখে জীবনের ইতিহাস বলা মানেই এক সামাজিক ইতিহাসের উন্মোচন। সেখানে রয়েছে বাল্যবিবাহের গল্প, দারিদ্র্য, অবহেলা, অকাল মৃত্যু—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি পল্লীজীবনের দগ্ধ হৃদয়ের দলিল।

“এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা”—এই পংক্তি কেবল পিতামাতার মৃত্যুর গল্প নয়, একটি সন্তানের দুঃখবোধ, আত্মদহন এবং পারিবারিক মায়ার প্রতিচ্ছবি। এই কবিতায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করা নয়, বরং মৃত্যুকে স্বীকার করে নেওয়ার ভেতর দিয়ে এক নির্মোহ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে।

এছাড়াও কবিতায় “বুজি”, “ফুফু”, এমনকি সাত বছরের মেয়ের অকালমৃত্যু পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে—যেখানে পাঠকের চোখ ভিজে যায় স্বাভাবিকভাবেই। “ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে, তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে”—এই পংক্তি কবিতার আবেগকে চরমে নিয়ে যায়।

এই কবিতার মধ্যে রয়েছে SEO-এর জন্য উপযুক্ত পাওয়ার ওয়ার্ড: চিরন্তন, হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী, বাস্তবতা, আত্মদহন, আবেগঘন, গ্রামীণ সৌন্দর্য, সাহিত্যিক মহাকাব্য, মৃত্যু ও ভালোবাসার কবিতা, প্রজন্মান্তরের সংলাপ, ইত্যাদি।

ফোকাস কীওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে:

  • কবর
  • কবর কবিতা
  • কবর কবিতা বিশ্লেষণ
  • কবর পল্লীকবি জসিমউদ্দীন
  • পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের কবিতা
  • বাংলা কবিতায় মাটি ও মৃত্যু
  • বাংলা আবেগঘন কবিতা
  • হৃদয়স্পর্শী বাংলা কবিতা
  • বাংলা কবিতায় গ্রামীণ জীবন
  • Bangla poem Kobor

এই HTML বিবরণটি Google-এর সার্চ র‍্যাংকে উন্নয়ন, কনটেন্ট ইনডেক্সিং এবং Bangla poetry খোঁজার আগ্রহীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এটি Yoast SEO, RankMath বা অন্য যে কোনো SEO প্লাগইনের জন্য একেবারে উপযুক্তভাবে তৈরি করা হয়েছে।

“কবর” কবিতা শুধুই শোকগাথা নয়, এটি এক গভীর আত্মিক আহ্বান—যেখানে জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও মৃত্যুর চিরন্তন ছায়া মিলে তৈরি করেছে বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য এক আবেগঘন অধ্যায়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x