কবিতার খাতা
আমি সেই মেয়েটি – কবিতা সিংহ
আমি সেই মেয়েটি,
সেই মেয়ে যার জন্মের সময়
কোনো শাঁখ বাজেনি,
জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষির ছকে বন্দী,
যার লগ্নরাশি রাহু কেতুর দিশা খোঁজা হয়েছে।
না, তার নিজের জন্য নয়,
তার পিতার জন্য
তার ভাইয়ের জন্য
তার স্বামীর জন্য
তার পুত্রের জন্য।
কিন্তু যাঁর গর্ভ থেকে তার জন্ম,
সেই মায়ের কথা বলেনি কেউ।
আমি সেই মেয়েটি
যে জন্ম থেকেই বিবাহের
জন্য বলিপ্রদত্ত।
যার বাইরের চেহারা—
চোখ, নাক, মুখ, ত্বক, চুল,
রঙ নিয়েই কেবল দরকষাকষি।
কালো না ফর্সা?
খাঁদা না টিকোলো?
লম্বা না বেঁটে?
কুৎকুতে না টানাটানা?
যার মাথার বাইরের জন্যই সকলের ভাবনা,
মাথার ভিতরটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
আমিই সেই মেয়েটি
যে ছোট্টবেলা থেকে শুনেছে—
জোরে জোরে কথা বলতে নেই,
ছুটতে নেই, চেঁচাতে নেই, হাসতে নেই,
এমনকি কাঁদলেও লুকিয়ে লুকিয়ে।
আমি সেই মেয়েটি
যাকে বলতে নেই—
ক্ষিদে পেয়েছে,
ঘুম পেয়েছে,
ইচ্ছে করছে না,
ক্লান্ত লাগছে,
আর পারছি না! আর পারছি না!
আমি সেই মেয়েটি
খেলার জন্য যার হাতে
তুলে দেওয়া হয়েছে পুতুল,
পুতুলের আদল পাওয়ার জন্য,
পুতুলের সংসার বানাবার জন্য।
আমি সেই মেয়েটি
যে জন্ম-জন্মান্তর আগের
প্রাগৈতিহাসিক জ্যোৎস্নারাত্রির স্বপ্ন দেখে,
এখনও আতঙ্কে চমকে চমকে উঠি।
সেই অর্ধদানব অর্ধমানবের
প্রস্তর কুড়ালে কাটা
আমার সিঁথি দিয়ে ঝরতে দেখেছি রক্তধারা।
আমার হাতে লোহার শিকল দিয়ে
হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি
এক গোষ্ঠী থেকে আর এক গোষ্ঠীর দিকে
লুষ্ঠিত সম্পদের মতো।
জন্ম-জন্মান্তরে আমি
বীর্যশুক্লার চৈতন্য বহন করে নিয়ে চলেছি।
আবার স্বপ্নভেঙে জেগে উঠে
দেখেছি সেই রক্তের চেতনায়
মেয়েরা যত্নে পরেছে সিন্দুর,
হাতে লোহার বালা।
আমি সেই মেয়েটি
যে গত কোন শতাব্দীতে
পাঁচ বছর বয়েসে মালা দিল
গঙ্গাযাত্রীর গলায়,
কুলীন ব্রাহ্মণের তিনশ পঁয়ষট্টিতম স্ত্রীর
অন্যতমা হয়ে।
স্বামীর গরবে হয়েছি গরবিনী।
একাদশীর দিন অবুঝ দশমী বালিকা
তৃষ্ণায় আটক ঘরের মাটি
লেহন করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করেছি।
সন্তানের পর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
রক্তশূন্যতায় মুখ থুবড়ে পড়েছি সুতিকাগারে।
জ্বলে পুড়ে মরেছি সতীদাহে।
আমার অসহায়ত্বের মধ্যে
পুরুষের পৌরুষত্ব ওৎ পেতে থাকে।
আমি বুঝতে পারিনি যে
চাকরির জায়গায় নিজের
কাজের কুশলতা দেখাতে নেই,
আমি বুঝতে পারিনি যে
আমার প্রেমিককে তার
প্রেমপত্রের ভুল বানানগুলো
ধরিয়ে দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছিলো।
আমি বুঝতে পারিনি যে
আমি যদি কবি হতে চাই,
আমার বন্ধুরা বলবেন—
ওটা কবিতা হয়নি, পদ্য হয়েছে।
আমি বুঝতে পারিনি যে
একবিংশ শতাব্দীর সীমানায় এসেও—
এই পুরুষ শাসিত পৃথিবী
বুদ্ধিমতীদের জন্য অপ্রস্তুত।
এখনও বিদেশে প্রতিভাশালিনীরা
নির্বোধ সেজে ছেলেদের সঙ্গে ডেট করে।
কারণ—
পুরুষেরা নিজেদের চেয়ে
বেশি বুদ্ধির ধার কখনও সহ্য করে না।
আমিই সেই মেয়েটি
যে দেখেছে একটি নারী কেমন করে
নিছক মেয়েছেলে বনে যায়।
চরিত্রের উল্টোদিকে হেঁটে যায়
সফল স্বামীদের গিন্নিরা।
শিক্ষার চেয়ে উজ্জ্বলতা পায় বেশি
নারসী শাড়ির ফুলকি,
বুদ্ধির চেয়ে দীপ্তিমান হয়ে ওঠে
অলঙ্কারের হীরা-পান্না।
আমিই সেই মেয়েটি
যে জীবনের কয়েকটা বছর
কেবল ভুলের পর ভুল পূরণরূপে ভুল করে চলেছি।
আমি বুঝতে পারিনি যে
আমাকে এফিসিয়েন্ট হতে নেই,
আমাকে আধো আধো গলায় বলতে হয়—
“আচ্ছা বলতে পারেন, ঠিক কোন্ বাসটা বেথুন কলেজের দিকে যায়?”
আমি সোজা, যে কোনো একটা ছেলের মত
আটাত্তরের সি-তে উঠে পড়েছি।
আমি বুঝতে পারিনি যে
বাসে উঠে রড ধরে সোজা দাঁড়াতে পারলে
লেডিস সিটের পুরুষেরা—
আমাকে কখনও জায়গা ছেড়ে দেবেনা।
টাল সামলাতে না পারার
ভান করে ঢলে পড়লেই আমার
মেয়েলিত্ব ফুল মার্কস পেয়ে যেতে পারে।
এভাবেই কিন্তু কিছু না
বুঝতে বুঝতে আমি এতদূর চলে এসে
আর ফিরতে পারি না।
এখন যে পাউডার লাগালে আমার এলার্জি হয়,
লিপস্টিক এত সুস্বাদু যে
আমি লাগালেই তা বেমালুম খেয়ে ফেলি।
এতদিন পরে আর কেঁচে গন্ডুষ করে
আমি ন্যাকা হতে পারি না।
অন্ধকারের দিকে ফিরতে পারি না
বলেই কি আমি অপমানের জ্বলন্ত কয়লার
ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে চাই?
যেতে চাই দুঃখের দিকে?
আমি প্রণাম জানাই
সেই প্রথম আগুনকে,
যার নাম বর্ণপরিচয়।
সেই অগ্নিশুদ্ধ পরম্পরাকে,
সেই সব পুরুষ-রমণীকে,
যাঁরা ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্ধকার হাতলে
জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে এক জন্মেই
আমাকে জন্ম-জন্মান্তরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
আমি আজ চরিত্রের দিকে
চলে যেতে যেতে খুলে ফেলেছি—
পণ দিয়ে কেনা বিবাহের ঝুটো গয়না,
সংস্কারের বেনারসী,
আমাকে ভুলিয়ে রাখার পানবাটা,
জদ্দার কৌটো।
আমাকে পায়াভারী করানোর জন্য
পিতা-স্বামী-শ্বশুরের পদস্থ পদবী।
আমি আজ প্রেমের জন্য
ফেলে যাচ্ছি আরাম,
স্বোপার্জিত শাকান্নের জন্য
ফেলে যাচ্ছি ভাতঘুম,
যন্ত্রণার জন্য ফেলে যাচ্ছি সুখ,
জ্ঞানের জন্য ফেলে যাচ্ছি সাফল্য,
অমৃতত্বের জন্য ঐশ্বর্য।
আমার হাতে জ্বলছে
দিশারিদের শিক্ষার মহান আগুন।
আমিই সেই মেয়েটি—আপনারা নিজেদের দর্পণে দেখে আমাকে চিনুন।