বাবা-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাবা বললেন,
অন্ধকারে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাক আমার জন্য
মাটির তলার একটা সুড়ঙ্গে নেমে গেলেন
খুব আস্তে আস্তে
আকাশে প্রান্ত নির্ণয় ভুল করে ছুটে গেল একটা উল্কা
বন্দরে একটাও জাহাজ নেই, রাস্তাগুলো দুলে ওঠে
কী যে হল
বুঝতে বুঝতেই কেটে গেল আরও উনিশটা বছর
এর মধ্যে কত হুড়োহুড়ি, কত মধুলোভীদের সঙ্গে ঘুরপাক
বাবা, বাবা!
বোতাম বোতাম মাশরুম খুব ইচ্ছে করে
বাবাকে খাওয়াতে
আর রুমালি রুটি
অন্তত একবার কাস্পিয়ান হ্রদের মাছের ডিম
ইচ্ছে করে একটা বারান্দাওয়ালা ঘর উপহার দিতে
বাবার থেকে এখন আমি বয়েসে অনেক বড়
আমার একুশটা হাত
তিনটে চোখ
প্রতিদিন সাতশো দরজা পেরিয়ে যাই
শ্যামপুকুর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আমার অল্পবয়েসি বাবা
বলে উঠি, সাবধানে যাও, গাড়ি চাপা পড়বে যে
ফুটপাথে ওঠো
পাঞ্জাবিতে বগলের নীচে ফুটো, আমার পাঞ্জাবি
লাগবে না বাবার গায়
একটাও দশতলা বাড়ি দেখেননি, আমি সেখানে থাকি
জেনে গেলেন না বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশ হয়েছে
তাঁর জন্মস্থান ঘিরে…
আমার ছেলে ঠাকুমার পাশে শুয়ে গল্প শোনে
ঘুম পাড়ানি গল্প
ঐ সব গল্প কিছুদিনের মধ্যেই শরীরে আঁট হয়ে যায়
নতুন নতুন গল্প বানাতে ছেলের দল হৈ হৈ করে ছুটছে
বিমানে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে
আমি
যতদিন বাবার ছেলে ছিলাম
তার চেয়ে বেশিদিন নিজেই বাবা
আমার বুকের সব রোম পাকা, সকালবেলা কাশতে কাশতে
লক্ষ করি, রক্ত পড়ছে কিনা
বাবা ছবি হয়ে থেমে আছেন।
নিজের থেকে কমবয়েসি কারুকে কি বাবা বলে ডাকা যায়?
তবু দেখতে পাই মাঝে মাঝে
আমিই চেয়ে থাকি স্নেহের দৃষ্টিতে
তাঁর ঘামে ভেজা মুখ, পরিক্রমা ক্লান্ত পা
কিছু দিতে ইচ্ছে হয়, যা যা পাননি
আমার ছেলের কাছ থেকে কিছু নেবার আগের মুহূর্তে
একবার আমার হাত কাঁপে!

বাবাকে নিয়ে আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন এখানে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাবা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাবা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতার অংশ

বাবা বললেন,
অন্ধকারে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাক আমার জন্য
মাটির তলার একটা সুড়ঙ্গে নেমে গেলেন
খুব আস্তে আস্তে
আকাশে প্রান্ত নির্ণয় ভুল করে ছুটে গেল একটা উল্কা
বন্দরে একটাও জাহাজ নেই, রাস্তাগুলো দুলে ওঠে
কী যে হল
বুঝতে বুঝতেই কেটে গেল আরও উনিশটা বছর
এর মধ্যে কত হুড়োহুড়ি, কত মধুলোভীদের সঙ্গে ঘুরপাক

বাবা, বাবা!
বোতাম বোতাম মাশরুম খুব ইচ্ছে করে
বাবাকে খাওয়াতে
আর রুমালি রুটি
অন্তত একবার কাস্পিয়ান হ্রদের মাছের ডিম
ইচ্ছে করে একটা বারান্দাওয়ালা ঘর উপহার দিতে
বাবার থেকে এখন আমি বয়েসে অনেক বড়
আমার একুশটা হাত
তিনটে চোখ
প্রতিদিন সাতশো দরজা পেরিয়ে যাই

শ্যামপুকুর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আমার অল্পবয়েসি বাবা
বলে উঠি, সাবধানে যাও, গাড়ি চাপা পড়বে যে
ফুটপাথে ওঠো
পাঞ্জাবিতে বগলের নীচে ফুটো, আমার পাঞ্জাবি
লাগবে না বাবার গায়
একটাও দশতলা বাড়ি দেখেননি, আমি সেখানে থাকি
জানলে না বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশ হয়েছে
তাঁর জন্মস্থান ঘিরে…

আমার ছেলে ঠাকুমার পাশে শুয়ে গল্প শোনে
ঘুম পাড়ানি গল্প
ঐ সব গল্প কিছুদিনের মধ্যে শরীরে আঁট হয়ে যায়
নতুন নতুন গল্প বানাতে ছেলের দল হৈ হৈ করে ছুটছে
বিমানে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে
আমি
যতদিন বাবার ছেলে ছিলাম
তার চেয়ে বেশিদিন নিজেই বাবা
আমার বুকের সব রোম পাকা, সকালবেলা কাশতে কাশতে
লক্ষ করি, রক্ত পড়ছে কিনা

বাবা ছবি হয়ে থেমে আছেন।
নিজের থেকে কমবয়েসি কারুকে কি বাবা বলে ডাকা যায়?
তবু দেখতে পাই মাঝে মাঝে
আমিই চেয়ে থাকি স্নেহের দৃষ্টিতে
তাঁর ঘামে ভেজা মুখ, পরিক্রমা ক্লান্ত পা
কিছু দিতে ইচ্ছে হয়, যা যা পাননি
আমার ছেলের কাছ থেকে কিছু নেবার আগের মুহূর্তে
একবার আমার হাত কাঁপে!

কবিতার বিশ্লেষণ

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “বাবা” কবিতাটি একটি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ রচনা, যেখানে বাবার প্রতি সন্তানের অগাধ ভালোবাসা এবং তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে। কবিতার মধ্যে রয়েছে সময়ের অতিক্রম, সম্পর্কের পরিবর্তন এবং জীবনের নানা পর্যায়ের অনুভূতির প্রতিফলন। এখানে একটি অবচেতন দুঃখ, এক ধরনের যন্ত্রণা এবং অনিবার্য শূন্যতার অনুভূতি প্রতিভাত হয়েছে। কবিতাটি পাঠককে স্মৃতির পটে ফেরে নিয়ে যায়, যেখানে বাবা আর সন্তান একসাথে ছিলেন, কিন্তু সময়ের সাথে সেই সম্পর্কটি দুর্বল হয়ে যায়। কবিতার মাধ্যমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, বাবা শুধু একটি ব্যক্তির নাম নয়, বরং একটি অনুভূতি, যা কখনো হারানো যায় না।

বাবা এবং সন্তানের সম্পর্ক

কবিতার মধ্যে বাবার প্রতি সন্তানের প্রেম, শ্রদ্ধা, এবং অভাব একটি গভীর একাত্মতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের দেখান যে, সম্পর্ক কখনো শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, বরং অনুভূতির গভীরতায় অনুভূত হয়। কবি নিজের সন্তানকে যখন কথা বলেন, তখন সেই সময়ের স্মৃতির সাথেও নিজেকে অঙ্গীকারাবদ্ধ মনে করেন। তিনি দেখান যে, সময়ের সাথে সম্পর্কের শক্তি আর টানাপোড়েন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু আসল প্রেম এবং শ্রদ্ধা কখনো মুছে যায় না।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x