এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুন ভট্টাচার্য | বাংলা কবিতা সংগ্রহ
কবিতা সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ
নবারুন ভট্টাচার্যের “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি যুগান্তকারী প্রতিবাদী রচনা। এই কবিতায় কবি রাজনৈতিক নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেছেন। নবারুন ভট্টাচার্যের এই কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে।
কবিতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এই কবিতাটি রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে। নবারুন ভট্টাচার্য তাঁর সময়ের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং পাঠকদের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী ধারার একটি মাইলফলক রচনা।
সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য ও শৈলী
কবিতাটির ভাষা অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও আক্রমণাত্মক। কবি নবারুন ভট্টাচার্য সরাসরি ও স্পষ্ট বাক্য গঠনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ছন্দ সৃষ্টি করেছেন। “আমি তাকে ঘৃণা করি” – এই ধরনের পুনরাবৃত্তি কবিতাটিকে একটি অনন্য মাত্রা দান করেছে। কবির শব্দচয়ন ও উপমা ব্যবহার বাংলা কবিতার ধারায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা অত্যন্ত তীব্র ও মর্মস্পর্শী।
দার্শনিক তাৎপর্য
এই কবিতায় কবি নবারুন ভট্টাচার্য মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংকটকে ফুটিয়ে তুলেছেন। “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না” – এই চরণগুলোর মাধ্যমে কবি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবিতাটি পাঠককে সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক সচেতনতার দিকে পরিচালিত করে।
কবিতার কাঠামোগত বিশ্লেষণ
নবারুন ভট্টাচার্যের “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” কবিতাটি একটি অনন্য কাঠামোয় রচিত। কবিতাটি শুরু হয় তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের ভাষায় এবং ধীরে ধীরে তা গণসংগ্রাম ও বিপ্লবের আহ্বানে রূপ নেয়। কবি নবারুন ভট্টাচার্য আন্তর্জাতিক কবি ও বিপ্লবীদের রেফারেন্স দিয়ে কবিতাকে বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছেন। কবিতাটির শেষাংশে আশার বার্তা ও বিজয়ের স্বপ্ন প্রকাশ পেয়েছে।
কবি নবারুন ভট্টাচার্য পরিচিতি
নবারুন ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের একজন প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর কবিতায় সামাজিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক দমনপীড়ন ও মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার গভীর চিত্রণ পাওয়া যায়। তিনি বাংলা কবিতায় নতুন ধারার সূচনা করেন এবং প্রতিবাদী কবিতাকে সমৃদ্ধ করেন। নবারুন ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন।
কবির সাহিত্যকর্ম
নবারুন ভট্টাচার্যের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ”, “উইল ফর সেলিব্রেশন”, “প্রেমের কবিতা”, “হাইবারনেশন” প্রভৃতি। তাঁর রচনাবলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে এবং আধুনিক বাংলা কবিতার বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতা বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমৃদ্ধ করেছে।
কবির সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক সচেতনতা ও শিল্পসৌকর্যের সমন্বয়। তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সামাজিক বাস্তবতার অদ্ভুত সমন্বয় লক্ষণীয়। নবারুন ভট্টাচার্য সরাসরি ও স্পষ্ট ভাষায় জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেন। তাঁর কবিতায় রয়েছে গভীর মর্মস্পর্শীতা ও প্রতিবাদের শক্তি।
কবিতা সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না কবিতার লেখক কে?
এই কবিতাটির রচয়িতা প্রখ্যাত বাংলা কবি নবারুন ভট্টাচার্য। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট প্রতিবাদী কবি হিসেবে স্বীকৃত।
কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু কী?
কবিতাটির মূল বিষয় হলো রাজনৈতিক নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
কবিতাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী?
এই কবিতার বিশেষত্ব হলো এর তীব্র প্রতিবাদী ভাষা, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং শক্তিশালী ছন্দ ও বাক্য গঠন।
নবারুন ভট্টাচার্যের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিতা কোনগুলো?
নবারুন ভট্টাচার্যের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে রয়েছে “যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ”, “উইল ফর সেলিব্রেশন”, “প্রেমের কবিতা”, “হাইবারনেশন” প্রভৃতি।
কবিতাটি কোন সাহিত্যিক ধারার অন্তর্গত?
এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী ধারার অন্তর্গত এবং এটি রাজনৈতিক কবিতার বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কবিতাটির সামাজিক প্রভাব কী?
এই কবিতাটি পাঠকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা শক্তিশালী করেছে।
কবিতাটির ভাষাশৈলীর বিশেষত্ব কী?
কবিতাটিতে ব্যবহৃত সরাসরি ও স্পষ্ট ভাষা, তীব্র প্রতিবাদী অভিব্যক্তি এবং গভীর রাজনৈতিক উপলব্ধি একে বাংলা কবিতার একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কবিতাটিতে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক কবিরা কারা?
কবিতাটিতে মায়কোভস্কি, হিকমেত, নেরুদা, আরাগঁ, এলুয়ার প্রমুখ আন্তর্জাতিক কবি ও বিপ্লবীদের উল্লেখ রয়েছে।
কবিতাটির শিরোনামের তাৎপর্য কী?
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” শিরোনামটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের প্রতীকী অভিব্যক্তি।
নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতার অনন্যতা কী?
নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতার অনন্যতা হলো রাজনৈতিক বাস্তবতা ও শিল্পসৌকর্যের পারফেক্ট সমন্বয় এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে আশার বার্তা প্রদান।
ট্যাগস: এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, নবারুন ভট্টাচার্য, বাংলা কবিতা, প্রতিবাদী কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা, বাংলা সাহিত্য, কবিতা সংগ্রহ, নবারুন ভট্টাচার্য কবিতা, আধুনিক বাংলা সাহিত্য, বাংলা কাব্য, রাজনৈতিক প্রতিবাদ
যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে
কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ঞায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।
আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। নবারুন ভট্টাচার্য।