কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এমনি করে কাজল কালো মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন এখানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিতা “কৃষ্ণকলি” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কৃষ্ণকলি” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমর সৃষ্টি, যেখানে কবি সমাজের প্রচলিত সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছেন। কবিতাটি কালো রূপের গভীর সৌন্দর্য্য এবং তার অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্যকে তুলে ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১২৯৩ সনে রচিত এই কবিতায় প্রকৃতির সাথে মানবিক সৌন্দর্য্যের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন।
কবিতার সারাংশ ও মূলভাব
“কৃষ্ণকলি” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন কালো বর্ণের মেয়ের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করেছেন, যাকে সমাজের লোকেরা সাধারণ সৌন্দর্য্যের মাপকাঠিতে কালো বলে উপেক্ষা করে। কিন্তু কবি তার কালো হরিণ-চোখের গভীরতা এবং মাধুর্য্যে মুগ্ধ। কবিতাটিতে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের সাথে এই মেয়ের সৌন্দর্য্যের তুলনা করা হয়েছে। কবি বারবার এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যে বাহ্যিক কালো রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে অপার সৌন্দর্য্য।
রূপক ও প্রতীক বিশ্লেষণ
কবিতায় “কালো হরিণ-চোখ” একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা মেয়েটির গভীর, রহস্যময় এবং মোহনীয় সৌন্দর্য্যকে চিত্রিত করে। এছাড়াও জ্যৈষ্ঠ মাসের কাজল কালো মেঘ, আষাঢ় মাসের কালো কোমল ছায়া এবং শ্রাবণ-রজনীর মতো প্রকৃতিক উপাদানগুলির সাথে তার সৌন্দর্য্যের তুলনা করা হয়েছে। কবি প্রকৃতির বিভিন্ন কালো উপাদানের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে কালো রংয়ের নিজস্ব এক গভীর সৌন্দর্য্য আছে।
কবির উদ্দেশ্য ও সাহিত্যধারা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত সৌন্দর্য্যের সংকীর্ণ সংজ্ঞাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং প্রকৃত সৌন্দর্য্য বাহ্যিক রূপের গভীরে নিহিত থাকে এই বার্তা দিয়েছেন। এটি বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক ধারার অন্তর্গত একটি কবিতা, যেখানে প্রকৃতি ও মানবিক অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটেছে। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের প্রগতিশীল চিন্তাধারারও পরিচয় বহন করে।
আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
এই কবিতায় কবির অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সৌন্দর্য্যের প্রতি তার গভীর উপলব্ধি ফুটে উঠেছে। কবিতাটি পাঠকের মনে সৌন্দর্য্যের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে এবং প্রচলিত ধারণাগুলোকে ভেঙে দেয়। কবির আবেগ প্রাণবন্ত এবং অন্তরঙ্গ, যা সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। কবির দৃষ্টিতে কৃষ্ণকলির সৌন্দর্য্য কোনো সাধারণ সৌন্দর্য্য নয়, এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি।
কবিতার কাঠামোগত বিশ্লেষণ
কবিতাটি পাঁচটি স্তবকে বিভক্ত, প্রতিটি স্তবকের শেষে একই পংক্তি পুনরাবৃত্তি হয়েছে: “কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।” এই পুনরাবৃত্তি কবিতাটিকে একটি বিশেষ ছন্দ ও গতি দান করেছে। প্রতিটি স্তবকে কবি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাধ্যমে কৃষ্ণকলির সৌন্দর্য্যকে চিত্রিত করেছেন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজে ফর্সা চামড়াকে সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে কালো বর্ণের সৌন্দর্য্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর এই কবিতা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বক্তব্য। কবিতাটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে সৌন্দর্য্য বাহ্যিক নয়, এটি অন্তরের গুণ।
শব্দচয়ন ও অলংকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতায় অসাধারণ শব্দচয়ন ও অলংকার প্রয়োগ করেছেন। “হরিণ-চোখ”, “কাজল কালো মেঘ”, “কালো কোমল ছায়া” – এই সব শব্দবন্ধ কবিতাকে বিশেষ মাত্রা দান করেছে। উপমা, রূপক ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতাকে শিল্পিত রূপ দান করেছে। কবির ভাষাশৈলী এতটাই প্রাণবন্ত যে পাঠক নিজেকে কবিতার মধ্যে খুঁজে পান।
মেটা ডেসক্রিপশন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কৃষ্ণকলি” কবিতার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা। কবিতার রূপক, উদ্দেশ্য, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং আবেগপূর্ণ বিশ্লেষণ যা এসইওর জন্য উপযোগী। কবিতার প্রথম লাইন: “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী কবিতা কৃষ্ণকলির গভীর বিশ্লেষণ।
FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)
কবিতাটি কোন সাহিত্যধারায় পড়ে?
এটি বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক ধারার অন্তর্গত একটি কবিতা, যেখানে প্রকৃতি ও মানবিক অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতায় রোমান্টিসিজমের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে।
কবিতার মূল রূপক কী?
“কালো হরিণ-চোখ” কবিতাটির মূল রূপক, যা মেয়েটির গভীর, রহস্যময় এবং মোহনীয় সৌন্দর্য্যকে চিত্রিত করে। এছাড়া প্রকৃতির বিভিন্ন কালো উপাদানও রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কবিতাটির প্রথম লাইন কী?
কবিতাটির প্রথম লাইন: “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।” এই প্রথম লাইনেই কবি তার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যান্য বিখ্যাত কবিতা কী কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যান্য বিখ্যাত কবিতার মধ্যে রয়েছে “সোনার তরী”, “মানসী”, “বলাকা”, “বিচিত্রা”, “চিত্রা”, “বনফুল”, “প্রভাত সংগীত” ইত্যাদি।
কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া?
“কৃষ্ণকলি” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কবি কাহিনী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে।
কবিতাটির সামাজিক গুরুত্ব কী?
এই কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণভেদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বক্তব্য রেখেছেন এবং সৌন্দর্য্যের নতুন সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কবিতার মূল বিষয়বস্তু
কবিতাটিতে কবি সমাজের প্রচলিত সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং কালো বর্ণের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্যকে তুলে ধরেছেন। কবি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের সাথে কালো বর্ণের সৌন্দর্য্যের তুলনা করেছেন। কবিতাটির মূল বক্তব্য হলো – সৌন্দর্য্য শুধু বাহ্যিক নয়, এটি অন্তরের গুণ এবং প্রকৃতির মতোই বৈচিত্র্যময়।
কবিতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
“কৃষ্ণকলি” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরও এক হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা পরবর্তী generations of কবি ও সাহিত্যিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
শিক্ষামূলক দিক
এই কবিতা থেকে আমরা শিখতে পারি যে সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা ব্যক্তিগত ও বিষয়ভিত্তিক। আমরা শিখতে পারি বৈচিত্র্যের মর্যাদা দিতে এবং সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলোকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করতে। কবিতাটি সহিষ্ণুতা ও গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষাও দেয়।
© Kobitarkhata.com – কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | বাংলা কবিতা বিশ্লেষণ