না পাঠানো চিঠি -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

না পাঠানো চিঠি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতার সারাংশ

কবিতাটি একটি মাকে লেখা চিঠি, যেখানে কবি তার অতীত, অভিমান ও ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। চিঠির মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে পরিবারের প্রতি এক গভীর প্রেম, তাছাড়া জীবনযাত্রার কঠিনতা ও অভাবের পাশাপাশি একজন সন্তানের আবেগ।

রূপক বিশ্লেষণ

কবিতে উল্লেখিত ‘মা’ এবং ‘শহর’ দুটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘মা’ একটি মাতৃত্বের চিহ্ন, যেখানে একজন সন্তানের নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও প্রেরণা নিহিত। অন্যদিকে ‘শহর’টি ব্যক্তিগত, সামাজিক সংগ্রাম এবং জীবনের বাস্তবতার প্রতীক।

কবির উদ্দেশ্য ও সাহিত্যধারা

কবি তার চিঠির মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা এবং পরিবারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সাহিত্যের দৃষ্টিতে এটি একটি আবেগঘন কবিতা, যেখানে মায়ের প্রতি বিশেষ একটি ভালোবাসা এবং তার অভাবে সৃষ্টি হওয়া আকুলতা রয়েছে।

আবেগ বিশ্লেষণ

এখানে কবির আধ্যাত্মিক আবেগ ও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি ফুটে উঠেছে। জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি, অভাব এবং পরিবারের প্রতি অনুভূতির গভীরতার একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যায়।

FAQ

‘না পাঠানো চিঠি’ কবিতার মূল থিম কী?

‘না পাঠানো চিঠি’ কবিতার মূল থিম হলো মায়ের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা, অভিমান এবং জীবনযাত্রার কঠিন বাস্তবতা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সাহিত্যধারা কী?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুলি সাধারণত প্রেম, মানবিকতা এবং সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে লেখা হয়।

© Kobitarkhata.com – কবি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মা, তুমি কেমন আছ?
আমার পোষা বেড়াল খুনচু সে কেমন আছে?
সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়?
দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়।

মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?
তুলিকে আমার ডুরে শাড়িটা পর়তে বোলো।
আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়।
তুলিকে কত মেরেছি! আর কোনদিন মারবো না।
আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা কোরো না
মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খর দিয়েছো?
এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব
তরফদার বাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে?
কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?

একবার মেঘের ডাক শুনে কৈ মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়
আমি আম গাছ তলায় দুটো কৈ মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা?
মনে আছে আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল?
চুরি করে আনিনি, মাটিতে পড়েছিল, কেউ দেখেনি
নারকোল বড়ার সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করতো।
বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চেলা কাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল আমাকে।

আমার কি দোষ, কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি?
আমার পিঠে এখনো সে দাগ আছে।
আলি সাহেবদের বাগানে আর কোনদিন যাইনি।
আমি আর কোনো বাগানেই যাই না
সেই দাগটায় হাত বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে।
বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়
আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি
বাবা যেনো আমার জন্য একটুও না ভাবে।

তুলি কি এখনো ভুতের ভয় পায়, মা?
তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলা বউ দেখেছিলাম
সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হলো
দাদা সেই কলা গাছটা কেটে ফেললো
আমি কিন্তু ভয় পাইনি, তুলি কে কত ক্ষেপিয়েছি
আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলা বউ দেখতে ইচ্ছে করে।

হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনো কাজ পেয়েছে?
নকুলবাবু যে বলেছিল, বহরমপুরে নিয়ে যাবে
দাদাকে বোলো আমি ওর উপরে রাগ করিনি
রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট
আমার শরীরে আর রাগ নেই,
আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না।

মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই
হোটেল থেকে দু’বেলা আমার খাবার এনে দেয়
মাংস মুখে দিই আর তুলির কথা,
কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে
তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না
আমি আলু পটলের তরকারি খাই,
পটল ভাজাও খাই।

হোটেলে কিন্তু কখনো শাক রান্না হয় না
পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক
কী ভালো, কী ভালো, বিনা পয়সায়
কোনোদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না।

জোর হাওয়া দিলে তাল গাছের পাতা শরশর করে
ঠিক বৃষ্টির মত শব্দ হয়।
এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে ডিব ডিব করে তাল পড়ে।
বাড়ির তাল গাছ দুটো আছে তো?
কালু তালের বড়া বড় ভালবাসে, একদিন বানিয়ে দিও
তেলের খুব দাম জানি,
তবু একদিন দিও

আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ’ হাজার টাকা পেয়েছিলে
তা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছে তো?
সেই গরুটা ভালো দুধ দেয়?
আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও অনেক ভালো
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়
গরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়
বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা

দু’বেলা ভাত দাও রে, শাড়ি দাও রে,
বিয়ের জোগাড় করো রে
হাবলু, মিজান, শ্রীধর দের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে।
আমি কি বুঝি না? সব বুঝি
কেন আমায় বিক্রি করে দিলে তাও তো বুঝি
সে জন্যই তো আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই।

আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পরে আছি।
তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিও ঠিকঠাক।
কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিও
তুলিকে ব্রজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো।
তুমি একটা শাড়ি কিনো, বাবার জন্য একটা ধুতি
দাদার একটা ঘড়ির সখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে?

আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, সোনার দুল গড়িয়েছি।
একদিন কি হলো জানো মা?
আকাশে খুব মেঘ জমে ছিল,
দিনের বেলায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
মনটা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠলো
দুপুরবেলা চুপি চুপি বের়িয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম
স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিকশা
খুব ইচ্ছে হলো,
একবার বাড়িটা দেখে আসি।

রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠলো-
কে যায়? কে যায়?
দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা
আমাকে বললো, হারামজাদী, কেন ফিরে এসেছিস?
আমি ভয় পেয়ে বললাম,
ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি
একবার শুধু দেখতে এসেছি
হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্যে মাগী
কী করে জানলো বলো তো,
তা কি আমার গায়ে লেখা আছে?

আর একটা ছেলে, চিনি না,বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম
হাবুল রিকশাওয়ালা কে চোখ রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা
আমি বললাম, দাদা, আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি
আর তুলির জন্য…
দাদা টেনে একটা চড় কষালো আমার গালে

আমাকে বিক্রির টাকা হকের টাকা
আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা
দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর
আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।

আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি
দাদা তো ঠিকই করেছে,
আমি তো আর দাদার বোন নই,
তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই
আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে
না, না আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো
গরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক
পুকুরে মাছ হোক, ক্ষেতে ধান হোক,
ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক
আর কোনোদিন ঐ গ্রাম অপবিত্র করতে যাবো না।

আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি,
দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি
আলমারি ভর্তি কাচের গেলাশ
বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি
এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে
তাহলেই বুঝছো, কেমন আরামে আছি আমি?

আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা
তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে,
আমি আর মা পাবো কোথায়?
সেইজন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা
তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে
তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল
যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা…
তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো,
তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়
যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিও
ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ।

আর যদি কোনোরকমই ওর বিয়ে দিতে না পারো?
ওকে বলো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে
মরলে ও বেঁচে যাবে!
না, না, না,
এ কী অলক্ষুণে কথা বলছি আমি
তুলি বেঁচে থাকুক,
আর সবাই বেঁচে থাকুক
তুলির বিয়ে যদি না হয় হোক
হে ভগবান,
গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না?
বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে?
দু’পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক
মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে,
জঙ্গল পেরিয়ে
আরও দূরে,
আরও দূরে,
যেদিকে দু’চোখ যায়
এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে,
কোথাও না কোথাও আছে
যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন
আঁচড়ে দেয় না,
কামড়ে দেয় না,
গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না,
লাথি মারে না
যেখানে একটা মেয়ে,
শুধু মেয়ে নয়,
মানুষের মত বাঁচতে পারে
মা, তুমি আমার মা,
আমি হারিয়ে গেছি
তুলিকে তুমি…তুলি যেন…আমার মতন না হয়!

আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন এখানেসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x