তারপর যে-তে যে-তে যে-তে
এক নদীর সঙ্গে দেখা।
পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা।
সে নদীর দুদিকে দুটো মুখ।
এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্য মুখে
ছুটতে ছুটতে চলে গেল।
আর
যেতে যেতে বুঝিয়ে দিল
আমি অমনি করে আসি
অমনি করে যাই।
বুঝিয়ে দিল
আমি থেকেও নেই,
না থেকেও আছি।
আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল
সময়
তারপর কানের কাছে
ফিসফিস করে বলল-
দেখলে !
কাণ্ডটা দেখলে !
আমি কিন্তু কক্ষনো
তোমাকে ছেড়ে থাকি না।
তার কথা শুনে
হাতের মুঠোটা খুললাম।
কাল রাত্রের বাসি ফুলগুলো
সত্যিই শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।
গল্পটার কোনো মাথামুণ্ডু নেই বলে
বুড়োধাড়ীদের একেবারেই
ভালো লাগল না।
আর তাছাড়া
গল্পটা বানানো।
পাছে তারা উঠে যায়
তাই তাড়াতাড়ি
ভয়ে ভয়ে আবার আরম্ভ করলাম:
‘তারপর যে-তে যে-তে যে-তে…
দেখি বনের মধ্যে
আলো-জ্বালা প্রকাণ্ড এক শহর।
সেখানে খাঁ-খাঁ করছে বাড়ি।
আর সিঁড়িগুলো সব
যেন স্বর্গে উঠে গেছে।
তারই একটাতে
দেখি চুল এলো করে বসে আছে
এক পরমাসুন্দরী রাজকন্যা।’…
লোকগুলোর চোখ চকচক করে উঠল।
তাদের চোখে চোখ রেখে
আমি বলতে লাগলাম-
‘তারপর সেই রাজকন্যা
আমার আঙুলে আঙুল জড়ালো।
আমি তাকে আস্তে আস্তে বললাম:
‘তুমি আশা,
তুমি আমার জীবন।’
শুনে সে বলল:
‘এতদিন তোমার জন্যেই
আমি হাঁ করে বসে আছি।’
বুড়োধাড়ীরা আগ্রহে উঠে ব’সে
জিগ্যেস করল: ‘তারপর?’
ব্যাপারটা তাদের মাথায় যাতে ঢোকে
তার জন্যে
ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে
মিলিয়ে যেতে যেতে আমি বললাম-
‘তারপর ? কী বলব-
সেই রাক্ষুসীই আমাকে খেলো।’
যেতে যেতে – সুভাষ মুখোপাধ্যায় | কাব্যিক সময় ও বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি
“যেতে যেতে” কবিতাটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর অন্যতম দার্শনিক কাব্যকর্ম, যা সময়, স্মৃতি, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে গঠিত। কবিতার শুরু থেকেই পাঠক এক অনিশ্চিত যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়, যেখানে সময় যেন এক ব্যক্তি হয়ে ওঠে এবং নদী, ঘুঙুর, নীল ঘাঘরা, শহর, রাজকন্যা ও রাক্ষুসী—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক বিমূর্ত জগৎ। প্রথম লাইন “তারপর যে-তে যে-তে যে-তে” আমাদের একটি অন্তহীন গতির মধ্যে প্রবেশ করায়, যা সময়ের প্রবাহ, স্মৃতির অলিগলি এবং গল্প বলার শৈলিকে প্রকাশ করে।
কবিতাটির প্রথম দৃশ্যেই নদীর সঙ্গে দেখা—নদীর ঘুঙুর বাঁধা পা, ঢেউয়ের নীল ঘাঘরা—এ যেন প্রকৃতি ও নারীর এক প্রতীকী সম্মিলন। এই নদী নিজের দুই মুখ দিয়ে এসে চলে যায়, যেন সময়ের প্রতিফলন, যা আমাদের অপেক্ষা করিয়ে নিজে চলে যায়। সময় এখানে কেবল নিরপেক্ষ ভৌত একক নয়, বরং একটি জীবন্ত সত্তা, যে ফিসফিস করে বলে দেয়: “আমি কিন্তু কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে থাকি না।”
কবিতায় কবির হাতে থাকা ‘বাসি ফুল’ সময়ের মৃত্যুর প্রতীক। সেই মুহূর্তে বোঝা যায়, যা ছিল তা আর নেই; যা আছে, তাও ধরতে পারা যায় না। এই জীবন, এই প্রেম, এই অপেক্ষা—সবই যেন একটি গল্প, যার শুরু-শেষ নেই। কবি এই গল্প বলেই চলেন, জানেন যে তাতে দর্শকের মন ভরে না, তবু বলেন। কারণ, এই গল্পগুলো আমাদের ভেতরের সত্যকে তুলে ধরে।
কবিতার দ্বিতীয় ভাগে, যেখানে গল্প আবার আরম্ভ হয়, দেখা যায় আলোর শহর, পরমাসুন্দরী রাজকন্যা, আঙুলে আঙুল জড়ানো প্রেম—এই সব মিলিয়ে যেন এক পৌরাণিক রূপকথা গড়ে ওঠে। কিন্তু এখানেই গল্প মোড় নেয়। পাঠক যখন ভালোবাসার আকর্ষণে বন্দী, তখন কবি বলে ফেলেন—“সেই রাক্ষুসীই আমাকে খেলো।” এটি বাস্তবতার নির্মম পরিণতি। প্রেম, স্বপ্ন, সময়—সবকিছুই শেষে হয়তো প্রতারণার শিকার।
“যেতে যেতে” কবিতাটি শুধুমাত্র গল্প নয়; এটি মানুষের চেতনার এক রূপান্তর। সময়ের অনুপস্থিতিতে অতীত ও ভবিষ্যতের সীমানা ধুয়ে যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষা সরল অথচ গভীর, যেন সহজ কথার মধ্যেই অনন্ত ভাবনার আশ্রয়। তাঁর কবিতার বিশেষত্ব হলো—তিনি পাঠককে প্রশ্ন করতে শেখান, উত্তর নয়।
কবিতায় ফোকাস থাকে মানবচরিত্রের দ্বিধা, স্মৃতি ও অনুতাপের ওপর। গল্পের মধ্য দিয়ে কবি একবার নদী, একবার শহর, একবার রাজকন্যা, আবার সময়কে চরিত্র করে তোলেন। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে—এই গল্প কার? বাস্তব, না কল্পনা? এমন গল্প যা বিশ্বাসযোগ্যও নয়, কিন্তু অনুভবযোগ্য। এই দ্বৈততাই কবিতাটিকে একটি বিশিষ্ট স্থান দেয় বাংলা আধুনিক সাহিত্যে।
এই কবিতা আবৃত্তির জন্যও অসাধারণ উপযোগী। তার শব্দচয়ন, ছন্দ এবং প্রতীকী গঠন শ্রোতার মনে এক রহস্যময় অনুভূতির জাল গড়ে তোলে। বিশেষ করে শেষ পঙক্তিগুলো—‘তারপর ? কী বলব—সেই রাক্ষুসীই আমাকে খেলো’—এই বাক্যগুলো শুনলেই শ্রোতা থমকে যান।
“যেতে যেতে – সুভাষ মুখোপাধ্যায়” কবিতাটি কেবল সাহিত্য নয়, সময় ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বের এক অসামান্য প্রতিবিম্ব। এটি আমাদের শেখায়, গল্প হয়তো বানানো, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে আমাদের অস্তিত্বের চিহ্ন।
ফোকাস কীওয়ার্ড:
- যেতে যেতে
- সুভাষ মুখোপাধ্যায়
- যেতে যেতে কবিতা
- বাংলা আধুনিক কবিতা
- গল্পনির্ভর কবিতা
- সময় ও স্মৃতি
- অভিজ্ঞতার কবিতা
- আবৃত্তির জন্য কবিতা
- SEO ফ্রেন্ডলি বাংলা কবিতা
এই ইনলাইন বর্ণনা অংশটি শুধুমাত্র সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যাতে “যেতে যেতে – সুভাষ মুখোপাধ্যায়” কবিতাটি সহজে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা এই অমূল্য রত্নের সন্ধান পান।