মেঘবালিকার জন্য রূপকথা — জয় গোস্বামী

আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতুহলে

“এই ছেলেটা,
. নাম কি রে তোর?”
আমি বললাম,
. “ফুসমন্তর !”

মেঘবালিকা রেগেই আগুন,
“মিথ্যে কথা । নাম কি অমন
হয় কখনো ?”
. আমি বললাম,
“নিশ্চয়ই হয় । আগে আমার
গল্প শোনো ।”

সে বলল, “শুনবো না যা-
সেই তো রাণী, সেই তো রাজা
সেই তো একই ঢাল তলোয়ার
সেই তো একই রাজার কুমার
পক্ষিরাজে
শুনবো না আর ।
. ওসব বাজে ।”

আমি বললাম, “তোমার জন্য
নতুন ক’রে লিখব তবে ।”

সে বলল, “সত্যি লিখবি ?
বেশ তাহলে
মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে ?
লিখেই কিন্তু আমায় দিবি ।”
আমি বললাম, “তোমার জন্য
লিখতে পারি এক পৃথিবী ।”

লিখতে লিখতে লেখা যখন
সবে মাত্র দু-চার পাতা
হঠাৎ তখন ভুত চাপল
আমার মাথায়-

খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম
ছোটবেলার মেঘের মাঠে
গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো
একটিও নেই এ-তল্লাটে

একজনকে মনে হল
ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই !
“তুমি কি সেই ? মেঘবালিকা
তুমি কি সেই ?”

সে বলেছে, “মনে তো নেই
আমার ওসব মনে তো নেই ।”
আমি বললাম, “তুমি আমায়
লেখার কথা বলেছিলে-”
সে বলল, “সঙ্গে আছে ?
ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে !
আর হ্যাঁ, শোন-এখন আমি
মেঘ নই আর, সবাই এখন
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায় ।”
বলেই হঠাৎ এক পশলায়-
চুল থেকে নখ- আমায় পুরো
ভিজিয়ে দিয়ে-
. অন্য অন্য
বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল খরস্রোতায়
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়
দূরে দূরে…।

“বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়-”
আপন মনে বলতে বলতে
আমিই কেবল বসে রইলাম
ভিজে একশা কাপড়জামায়
গাছের তলায়
. বসে রইলাম
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য

এমন সময়
অন্য একটি বৃষ্টি আমায়
চিনতে পেরে বলল, “তাতে
মন খারাপের কি হয়েছে !
যাও ফিরে যাও-লেখ আবার ।
এখন পুরো বর্ষা চলছে
তাই আমরা সবাই এখন
নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত
তুমিও যাও, মন দাও গে
তোমার কাজে-
বর্ষা থেকে ফিরে আমরা
নিজেই যাব তোমার কাছে ।”
এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে
ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম
গহন বনে
সঙ্গী শুধু কাগজ কলম

একাই থাকব । একাই দুটো
ফুটিয়ে খাব—
. দু এক মুঠো
ধুলো বালি-যখন যারা
আসবে মনে
. তাদের লিখব
লিখেই যাব !

এক পৃথিবীর একশোরকম
স্বপ্ন দেখার
সাধ্য থাকবে যে-রূপকথার—
সে রূপকথা আমার একার ।

ঘাড় গুঁজে দিন
. লিখতে লিখতে
ঘাড় গুঁজে রাত
. লিখতে লিখতে
মুছেছে দিন—মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত
অসাড় হল,
. মনে পড়ল
সাল কি তারিখ, বছর কি মাস
সেসব হিসেব
. আর ধরিনি
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখব বলে
একটা খাতাও
. শেষ করিনি ।

সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি এল খাতার উপর
আজীবনের লেখার উপর
বৃষ্টি এল এই অরণ্যে
বাইরে তখন গাছের নিচে
নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ-গাছ ও-গাছ উড়ছে পাখি
বলছে পাখি, “এই অরণ্যে
কবির জন্যে আমরা থাকি ।”
বলছে ওরা, “কবির জন্য
আমরা কোথাও আমরা কোথাও
আমরা কোথাও হার মানিনি—”

কবি তখন কুটির থেকে
তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে, মাঠের পরে
নদীর পরে
সেই যেখানে সারাজীবন
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে,
সেই যেখানে কেউ যায়নি
কেউ যায় না কোনদিনই—
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝরনাতলায়
এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘহরিণী—
কিশোর বেলার সেই হরিণী

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা – জয় গোস্বামী

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা জয় গোস্বামীর একটি গভীর আবেগপ্রবণ এবং কাব্যিক রূপকথা, যেখানে শৈশব, কল্পনা, বৃষ্টি এবং হারিয়ে যাওয়া সময় এক আশ্চর্য মোহে মিশে যায়। কবিতার প্রথম লাইন “আমি যখন ছোট ছিলাম খেলতে যেতাম মেঘের দলে” পাঠককে নিয়ে যায় এক নিস্পাপ সময়ের স্মৃতিতে, যেখানে মেঘ, বালিকা, বৃষ্টি ও কল্পনা এক হয়ে যায় রূপকথার গল্পে।

এই কবিতাটি বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। জয় গোস্বামী তার স্বভাবসিদ্ধ কল্পনাশক্তি ও দার্শনিক আবেগ দিয়ে মেঘবালিকার সাথে কথোপকথনের মধ্যে শিশুর কল্পনার উচ্ছ্বাস ও পরিণত বয়সের নিঃসঙ্গতা পাশাপাশি উপস্থাপন করেছেন। এটি শুধুমাত্র একটি কবিতা নয়, এটি এক জীবনভরের যাত্রার দিনলিপি, যেখানে ‘লিখে যাওয়া’ একটি জীবনের প্রতীক হয়ে উঠে।

ফোকাস কিওয়ার্ড হিসেবে “মেঘবালিকার জন্য রূপকথা” ব্যবহার করা হলে দেখা যায়, এটি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে বিশেষ আবেদন রাখে। পাঠকেরা গুগলে “জয় গোস্বামীর সেরা কবিতা” বা “মেঘবালিকার জন্য রূপকথা কবিতার বিশ্লেষণ” বলে সার্চ করে থাকেন। এটি এমন এক কবিতা, যেখানে শৈশবের মেঘ ও বড়বেলার বৃষ্টির মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করেছেন কবি।

আমি বললাম, ‘তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী’”—এই লাইনটিতে যে প্রেম, প্রতিশ্রুতি ও লেখকসত্তার দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়, তা জয় গোস্বামীর কবিতার মেরুদণ্ড। তার কবিতায় যেমন থাকে ব্যক্তিগত অনুভব, তেমনি থাকে এক সার্বজনীন যন্ত্রণা ও স্বপ্নবন্দনা।

এই কবিতায় আরও যে বিষয়টি আলাদা করে চোখে পড়ে তা হলো—মেঘবালিকার রূপান্তর। সময়ের প্রবাহে সে আর মেঘ নয়, সে বৃষ্টি। এখানে কবি বুঝিয়ে দেন, জীবনে যাকে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, সে-ও বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার ব্যথা আর লেখার অসমাপ্ততা যেন কবির জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি।

এক পৃথিবী লিখবো আমি, এক পৃথিবী লিখবো বলে”—এই প্রতিজ্ঞা কবির শিল্পসত্তার জন্ম দেয়। পাঠক বুঝতে পারে, কবি কেবল একজন প্রেমিক নন, তিনি একজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ লেখক, যিনি একাই বনভূমিতে বাস করেন, কেবল কাগজ-কলমকে সঙ্গী করে।

এই কবিতা সময় ও স্মৃতির মধ্যে এক ধ্রুপদী সংলাপ। বর্তমান ও অতীতের মিলনবিন্দুতে দাঁড়িয়ে কবি যেমন তাঁর ভেতরের শিশু ও প্রবীণের কথোপকথন রচনা করেছেন, তেমনি পাঠকের মনেও জেগে ওঠে তাদের নিজস্ব শৈশব ও বিস্মৃত প্রণয়ের স্মৃতি।

কবির জন্যে আমরা থাকি”—এই পাখিদের কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপটি পুরো কবিতার সর্বোচ্চ পয়েন্ট হয়ে ওঠে। কবি একা নন, প্রকৃতি, বৃষ্টি, পাখি, ময়ূর—সবাই কবির জন্য এক নিবেদিত বাস্তু তৈরি করে। এই কল্পলোকে পাঠক আবিষ্কার করে নিজের জায়গা, নিজের নিঃসঙ্গতা ও সৃষ্টির বাসনা।

বাংলা সাহিত্যের SEO দৃষ্টিকোণ থেকে, “মেঘবালিকার জন্য রূপকথা কবিতা”, “জয় গোস্বামী কবিতা”, এবং “আমি যখন ছোট ছিলাম খেলতে যেতাম মেঘের দলে” এই কিওয়ার্ডগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিয়ে বাংলা কবিতা প্রেমীরা নিয়মিত গুগলে অনুসন্ধান করে থাকেন।

এই কবিতাটি কেবল একটি গল্প নয়, এটি আমাদের সময় ও স্মৃতির প্রতি এক নিরব নিবেদন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শৈশব চলে যায়, ভালোবাসার মানুষ বদলে যায়, লেখার খাতা শেষ হয় না, কিন্তু কবিতা—সেই অনন্ত বৃষ্টির দেশে আমাদের নিয়ে যেতে পারে বারবার।

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা” হলো সেই কবিতা, যেটি হৃদয়ের গভীরে শেকড় গেঁড়ে বসে থাকে। এটি শুধু জয় গোস্বামীর কবিতা নয়, এটি পাঠকের নিজের লেখা, নিজের গল্প—যেটা সে কোনোদিন শেষ করতে পারে না। এই কবিতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা নিজের ভিজে কাপড়ে বসে থাকি—আর অপেক্ষা করি, যদি আবার কেউ এসে বলে, “তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী।”

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x