কবিতার খাতা
দুর্বোধ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অধ্যাপক মশায় বোঝাতে গেলেন নাটকটার অর্থ,
সেটা হয়ে উঠল বোধের অতীত। আমার
সেই নাটকের কথা বলি-বইটার নাম ‘পত্রলেখা’ নায়ক তার কুশল সেন।
নবনীর কাছে বিদায় নিয়ে সে গেল বিলেতে।
চার বছর পরে ফিরে এসে হবে বিয়ে।
নবনী কাঁদল উপুড় হয়ে বিছানায়, তার মনে হ’ল,
এ যেন চার বছরের মৃত্যুদন্ড।
নবনীকে কুশলের প্রয়োজন ছিল না ভালোবাসার পথে, প্র
য়োজন ছিল সুগম করতে বিলাত যাত্রার পথ।
সে কথা জানত নবনী, সে পণ করেছিল হৃদয় জয় করবে প্রাণপণ সাধনায়।
কুশল মাঝে মাঝে রুচিতে বুদ্ধিতে উচট্ খেয়ে ওকে বলেছে রূঢ় কথা,
ও সয়েছে চুপ করে; মেনে নিয়েছে নিজেকে অযোগ্য বলে;
ওর নালিশ নিজেরেই উপরে।
ভেবেছিল দীনা বলেই একদিন হবে ওর জয়,
ঘাস যেমন দিনে দিনে নেয় ঘিরে কঠোর পাহাড়কে।
এ যেন ছিল ওর ভালবাসার শিল্প রচনা,
নির্দয় পাথরটাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে রূপ আবাহন করা ব্যথিত বক্ষের নিরন্তর আঘাতে।
আজ নবনীর সেই দিন-রাতের আরাধনার ধন গেল দূরে।
ওর দুঃখের থালাটি ছিল অশ্রুভেজা অর্থে ভরা, আজ থেকে দুঃখ রইবে
কিন্তু দুঃখের নৈবেদ্য রইবে না।
এখন ওদের সম্বন্ধের পথ রইল শুধু এপারে ওপারে চিঠি লেখার সাঁকো বেয়ে।
কিন্তু নবনী তো সাজিয়ে লিখতে জানে না মনের কথা,
ও কেবল যত্নের স্বাদ লাগাতে জানে সেবাতে,
অরকিডের চমক দিয়ে যেতে ফুলদানির ‘পরে কুশলের চোখের আড়ালে;
গোপনে বিছিয়ে আসতে নিজের হাতে কাজ করা আসন যেখানে কুশল পা রাখে।
কুশল ফিরল দেশে, বিয়ের দিন করলো স্থির।
আংটি এনেছে বিলেত থেকে, সেটা গেল পরাতে;
গিয়ে দেখে ঠিকানা না রেখে নবনী নিরুদ্দেশ।
তার ডায়ারিতে আছে লেখা, “যাকে ভালোবেসেছি সে ছিল অন্য মানুষ,
চিঠিতে যার প্রকাশ, এ তো সে নয়।”
এ দিকে কুশলের বিশ্বাস তার চিঠিগুলি গদ্যে মেঘদূত, বিরহীদের চিরসম্পদ।
আজ সে হারিয়েছে প্রিয়াকে, কিন্তু মন গেল না চিঠিগুলি হারাতে,
ওর মমতাজ পালাল, রইল তাজমহল।
নাম লুকিয়ে ছাপালো চিঠি ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেমিক’ আখ্যা দিয়ে।
নবনীর চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা হয়েছে বিস্তর।
কেউ বলেছে, বাঙালীর মেয়েকে লেখক এগিয়ে নিয়ে চলেছে
ইবসেনের মুক্তিবানীর দিকে, কেউ বলেছে, রসাতলে।
অনেকে এসেছে আমার কাছে জিজ্ঞাসা নিয়ে,
আমি বলেছি, “আমি কী জানি।”
বলেছি, “শাস্ত্রে বলে, দেবা ন জানন্তি।” পাঠক বন্ধু বলেছে,
“নারীর প্রসঙ্গে না হয় চুপ করলেম হতবুদ্ধি দেবতারই মতো,
কিন্তু পুরুষ? তারও কি অজ্ঞাতবাস চিররহস্যে। ও মানুষটা হঠাৎ পোষ মানলে কোন্ মন্ত্রে।”
আমি বলেছি-“মেয়েই হোক আর পুরুষই হোক
স্পষ্ট নয় কোন পক্ষই; যেটুকু সুখ দেয় বা দুঃখ দেয়
স্পষ্ট কেবল সেইটুকুই।
প্রশ্ন কোরো না, পড়ে দেখো কি বলছে কুশল।”
কুশল বলে
“নবনী চার বছর ছিল দৃষ্টির বাইরে,
যেন নেমে গেল সৃষ্টির বাইরেতেই, ওর মাধুর্যটুকুই রইলো মনে,
আর সবকিছু হল গৌণ। সহজ হয়েছে ওকে সুন্দর ছাঁদে চিঠি লিখতে।
অভাব হয়েছে, করেছি দাবি, ওর ভালবাসার উপর অবাধ ভরসা
মনকে করেছে রসসিক্ত, করেছে গর্বিত।
প্রত্যেক চিঠিতে আপন ভাষায় ভুলিয়েছি আপনারই মন।
লেখার উত্তাপে ঢালাই করা অলঙ্কার ওর স্মৃতির মূর্তিটিকে
সাজিয়ে তুলেছে দেবীর মতো। ও হয়েছে নূতন রচনা।”
এই জন্যেই খ্রীস্টান শাস্ত্রে বলে, “সৃষ্টির আদিতে ছিল বাণী।”
পাঠক বন্ধু আবার জিগেস করেছে, “ও কি সত্যি বললে,
না, এটা নাটকের নায়কগিরি?”
আমি বলেছি, “আমি কী জানি”।