চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ- আবুল হাসান

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ – আবুল হাসান

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ – আবুল হাসান

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক, পুলিশ বিভাগে চাকরি কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধূলো, হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেরার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকরবাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী, পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনি একবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকেল।

মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থপ্রেমিক
কৃপা ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে।

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভঅলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোলছেন, এই দ্যাখোতো
জলের রং এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবেনা?

আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জা ব্রীড়া, ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদিতে মিশেছিলুম, বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোপায়।

মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুষ খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?

বাবা তখন হাতের বোনা চাদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়
কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে
লোকের ভীড়ে সামান্য লোক, শিশিরগুলি চোখে মাখাতেন।

এখন তিনি পরাজিত, কেউ দ্যাখেনা একলা মানুষ
চিলেকোঠার মতোন তিনি আকাশ দ্যাখেন, বাতাস দ্যাখেন
জীর্ণ শীর্ণব্যর্থচিবুক বিষন্নলাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,
হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন।

একটি ছেলে ঘুরে বেড়ায় কবির মতো কুখ্যাত সব পাড়ায় পাড়ায়
আর ছেলেরা সবাই যে তার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবা একলা শিরদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কী যে ভাবেন,
প্রায়ই তিনি রাত্রি জাগেন, বসে থাকেন চেয়ার নিয়ে

চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ।

কবিতার সামাজিক বিশ্লেষণ

এই কবিতার মধ্যে মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবুল হাসান তার অনুভূতি ও কষ্ট প্রকাশ করেছেন। একদিকে, তাঁর বাবার জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে সমাজের নিচুতলা এবং তাদের সংগ্রামের ছবি ফুটে ওঠে। বাবার কর্মজীবন, যার মধ্যে ছিল সরকারের অধীনস্থ পুলিশ বিভাগে চাকরি, এবং তার সাথে থাকা বৈষম্য ও দুর্দশা, যা সমাজের অগণিত মানুষের বাস্তবতা। আরেকদিকে, বাবা ও মায়ের সম্পর্কের বিষাদ, যেখানে মাতৃস্নেহ ও পিতার খোলামেলা স্নেহের অভাব এবং সামাজিক ব্যর্থতা ফুটে ওঠে।

সমাজের নানা স্তরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

এই কবিতা শুধু ব্যক্তি জীবনের না, বরং একটি জাতির বিবর্ণ চিত্রও তুলে ধরে। যেখানে সমাজের উচ্চতর স্তরের মানুষের লোভ-লালসা, ঘুষ, জমিজমা কেনাবেচা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আসক্তি দৃশ্যমান। বাবার এই কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি এক ধরনের অসন্তুষ্টি ফুটে ওঠে, যা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন।

নিম্নমানের মানুষদের গল্প

কবিতার মধ্যে “চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ” এই অংশটি একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামেলী হাতে যে ‘নিম্নমানের মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন, তারা আসলে সমগ্র সমাজের একজন সদস্য, যারা কখনোই আলোচনায় আসে না, কিন্তু সমাজের প্রতি তাদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

কবিতার শেষ বার্তা

কবিতায় একটা সরল ও কঠিন পরিস্কার ছবি উঠে আসে, যেখানে পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ব্যর্থতা ও সংগ্রাম প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, সমাজে এক শ্রেণির মানুষ যাদের প্রয়োজনীয় সম্মান বা মূল্যায়ন মিলছে না, তারা তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বা টিকে থাকতে নানা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।

বিপ্লবের আহ্বান

আবুল হাসান তার এই কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন যে, মানুষের সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক প্রসঙ্গ। যেসব মানুষ সমাজের প্রতি অবহেলিত, তাদের জীবনে একই ধরনের সংগ্রাম থাকে যা নিঃসন্দেহে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইঙ্গিত দেয়। এটি একধরনের প্রতীকি প্রতিবাদ, যেখানে ভাষা ও চিত্রের মাধ্যমে কবি সমাজের দুর্বলতাগুলোকে উন্মোচন করেছেন।

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক,পুলিশ বিভাগে চাকরি কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধূলো,হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেরার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকরবাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী ,পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনি একবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকেল।

মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থপ্রেমিক
কৃপা ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে।

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভঅলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোলছেন,এই দ্যাখোতো
জলের রং এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবেনা?

আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জা ব্রীড়া,ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদিতে মিশেছিলুম,বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোপায়।

মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুষ খাচ্ছে,জমি কিনছে,শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,

বাবাকে নিয়ে আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন এখানে।

আবিুল হাসান ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x