কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি – মল্লিকা সেনগুপ্ত

কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি
নতুন করে সাজিয়ে নিতাম ঘুঁটি
আমি তখন পঁচিশ বসন্তের
যেন ভিনাস, সাগর থেকে উঠি।

কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি
অন্য কোনও জীবন বেছে নিতাম
ঘূর্ণি তুলে হেঁটে যেতাম চাঁদে
তারায় তারায় উঠত জ্বলে নাম

হিলহিলে ত্বক, চেকনাই চোখমুখ
সাজপোশাকে লাগিয়ে দেব তাক
যে দেখবে তার ঘুরবে মাথা ভোঁ ভোঁ
খুশি হবেন বুড়ো প্যাট্রিয়ার্ক।

নিজের ডাকা স্বয়ংবর সভায়
বেছে নিতাম সুপারম্যান হিরো
অ্যান্টোনিও ব্যান্ডেরাসের দিকে
ছুড়ে দিতাম বসন্তের তিরও।

গম্ভীর এই দিদিমণির মুখে
বসিয়ে দিতাম মোনালিসার হাসি
যে কথা আমি বলিনি কোনওদিন
বলে উঠব, তোমায় ভালবাসি।

কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি – মাল্লিকা সেনগুপ্ত | আধুনিক নারীর কল্পনা ও প্রেমের কাব্য

“কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি” কবিতাটি মাল্লিকা সেনগুপ্ত-এর এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে একজন পরিণত নারীর কল্পনা, অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা এবং সমাজ-নির্ধারিত সৌন্দর্য ধারণার বিরুদ্ধে এক প্রতিস্পর্ধী উচ্চারণ উঠে আসে। কবিতার প্রতিটি স্তবক যেন এক একটি জীবনানুভব, যা ফিরে চায় যৌবনের সেই উচ্ছলতা, স্বপ্ন, ও স্বাধীনতা। নারীর নিজের পছন্দ, ইচ্ছা ও অস্তিত্বকে নতুনভাবে চিনে নেওয়ার এক সাহসী প্রয়াস এই কবিতা।

কবিতার শুরুতেই আসে এক কল্পনা—যদি কুড়ি বছর আগের সময় ফিরে পাওয়া যেত! তখন পঁচিশ বসন্তের নারীটি যেন স্বয়ং ‘ভিনাস’, সমুদ্র থেকে উদ্ভাসিত সৌন্দর্যের দেবী। এই উপমার মধ্য দিয়ে কবি নারী শরীরের জাগরণ, আত্মপ্রেম এবং নারীত্বের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। নারী এখানে কেবল পুরুষের দৃষ্টির বস্তু নন, বরং নিজেকে দেখার এক নতুন ভঙ্গি।

সময় ফিরে পেলে, জীবনের অন্য পথ বেছে নিতেন কবি। এখানে সময়ের অনুশোচনা নয়, বরং জীবনের অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনার কথাই বলেছেন তিনি। ‘চাঁদে ঘূর্ণি তুলে হাঁটা’ কিংবা ‘তারায় তারায় জ্বলে ওঠা’ কেবল কল্পনা নয়, এগুলো নারীর স্বাধীন ইচ্ছার রূপান্তর, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গণ্ডি ভেঙে জীবনকে নতুন করে সাজানোর আহ্বান রয়েছে। কবিতায় নারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধীন অস্তিত্বের ভাষা।

ত্বকের বয়স, মুখের গঠন, চেহারার ‘চেকনাই’ – সবই আবার নতুন করে ভাঙাগড়ার খেলা। কবিতায় বলা হয়, সাজপোশাকে এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা হবে যেন সেই নারীর সৌন্দর্যে পুরুষপ্রধান সমাজ ‘প্যাট্রিয়ার্ক’ পর্যন্ত কেঁপে উঠে। এটি কেবল কৌতুক নয়, বরং এক দার্শনিক প্রতিঘাত — বয়সকে নয়, নারীর ইচ্ছাকেই কেন্দ্র করা উচিত। নারীর সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ আত্মসম্মানের এক বিকাশ।

কবিতায় আরও আছে কল্পিত প্রেমিকের চিত্র। “স্বয়ংবর সভা” — যা একাধারে পৌরাণিক ও আধুনিক — সেই সভায় কবি নিজেই নায়িকা, যিনি বেছে নেন ‘সুপারম্যান’ কিংবা ‘অ্যান্টোনিও ব্যান্ডেরাস’-এর মতো জনপ্রিয় পুরুষ চরিত্রদের। এখানে নারীর ক্ষমতা ও নিজের পছন্দে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রেমিকের পছন্দ নারীর অধিকার, সমাজের চাপ নয়।

“মোনালিসার হাসি”, “তোমায় ভালোবাসি” — এই দুটি পঙক্তি কাব্যটির আবেগঘন ও ব্যক্তিগত পরিণতির দিকটি তুলে ধরে। যে কথা বলা হয়নি কখনো, সেটি বলে ওঠার সাহস – কবিতাটি সেই নিরব অভিব্যক্তির কণ্ঠস্বর। দিদিমণির মুখে যখন ‘মোনালিসার হাসি’ বসে, তখন সেটি বয়স-নির্ভর সৌন্দর্যের বিপরীতে দাঁড়ানো আত্মপ্রকাশ হয়ে ওঠে। যেটুকু বলা হয়নি, তা-ই হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ।

“কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি” কবিতাটি কেবল এক নারীর অতীতের কল্পনাই নয়, এটি একটি সামাজিক ও মানসিক পুনঃমূল্যায়নের প্রতিচ্ছবি। নারী যে কেবল মায়ের, স্ত্রীর, কিংবা শিক্ষিকার ভূমিকায় আবদ্ধ নয়—তাঁর মধ্যেও বাস করে এক স্বাধীনচেতা কিশোরী, এক স্বপ্নবাজ প্রেমিকা, এক সৌন্দর্যবিলাসী দেবী। এই কবিতার প্রতিটি চরণে সেই গূঢ় সত্য উন্মোচিত হয়। কবি এখানে জীবন ও প্রেমকে এক নবতর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, যেখানে নারী নিজেই নিজের নিয়তি রচনা করে।

কবিতাটি আবৃত্তির জন্য দারুণ উপযোগী। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি চিত্রকল্প শ্রোতার মনে প্রেম, স্বাধীনতা ও আত্মচেতনার আবেগ জাগিয়ে তোলে। এটি কেবল একটি কবিতা নয়, বরং নারীর আত্মদর্শনের একটি আধুনিক দলিল। পাঠক বা শ্রোতা উভয়ের কাছেই এটি হয়ে ওঠে আত্মসম্মান, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নের প্রতিবিম্ব।

পাশাপাশি, মাল্লিকা সেনগুপ্ত যে সাহসিকতা ও স্পষ্টতায় নারীর অস্তিত্ব এবং স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারা ও নারীবাদী চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। “কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি” কেবল কল্পনার কাব্য নয়, বরং তা এক নারীর জীবনের অব্যক্ত ইতিহাস, অনুচ্চারিত ভালবাসা, এবং স্বাধীনতার শক্তিশালী ঘোষণাপত্র। এমন সাহসী, নান্দনিক ও হৃদয়স্পর্শী কাব্যিক প্রকাশ বাংলায় খুব কমই দেখা যায়।

এই কবিতা আজকের দিনে এসে নারীদের নিজস্ব কণ্ঠে স্বপ্ন বলা ও দাবি তোলার অধিকারকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি নারী পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায় এবং পুরুষ পাঠককে নারীজীবনের সূক্ষ্ম অনুভব অনুধাবনের সুযোগ দেয়। তাই “কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি” শুধু একটি কবিতা নয়, বরং একটি নীরব বিপ্লব, একটি রূপান্তরের ভাষা।

ফোকাস কীওয়ার্ড:

  • কুড়ি বছর ফিরে পেতাম যদি
  • মাল্লিকা সেনগুপ্ত
  • আধুনিক বাংলা কবিতা
  • নারীর কল্পনা
  • নারীর স্বাধীনতা
  • আবৃত্তির বাংলা কবিতা
  • নারীবাদী কবিতা
  • সমাজ সচেতন কবিতা
  • রোমান্টিক আধুনিক কবিতা
  • SEO ফ্রেন্ডলি বাংলা কবিতা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x