এলিজি : আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে- আবিদ আজাদ।

এলিজি : আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে – আবিদ আজাদ | কবিতা বিশ্লেষণ

আবিদ আজাদের “এলিজি : আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে” কবিতাটি একটি গভীর শোকগাথা যা শহুরে জীবন, স্মৃতি এবং অনুপস্থিতির জটিল আবেগকে ধারণ করে। কবিতাটি ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে রচিত যেখানে কবি তার প্রয়াত বন্ধু আবুল হাসানের স্মৃতিকে ধারণ করে চলেছেন।

কবিতার সারমর্ম

এই কবিতায় কবি আবুল হাসানের অনুপস্থিতিতে ঢাকা শহরের শূন্যতা এবং নিজের একাকিত্বকে চিত্রায়িত করেছেন। কবিতাটির মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থান যেমন মতিঝিল, বনানী, রমনা, ফুলার রোড, ন্যুমার্কেট, বুড়িগঙ্গা প্রভৃতি স্থানের বর্ণনার মধ্য দিয়ে এক গভীর মর্মবেদনা ফুটে উঠেছে। কবি শহরকে একজন জীবন্ত সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যে তার প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতিতে কষ্ট পাচ্ছে।

রূপক ও প্রতীক বিশ্লেষণ

কবিতাটিতে অসংখ্য শক্তিশালী রূপক ও প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে। “ইটের গাঁথুনি”, “সিমেন্টের মায়ামমতা”, “ভেন্টিলেটরের ফাঁক-ফোকর” – এসব প্রতীক শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতাকে নির্দেশ করে। “কাঠঠোকরা পাখি” রূপকটি ব্যবহৃত হয়েছে আত্মগত বেদনা প্রকাশের জন্য, যে পাখি নিজের বুকেই আঘাত করে।

প্রধান রূপকসমূহ

শহরটি এখানে একজন শোককারী মানুষের রূপক, যে তার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে শোক করছে। “মতিঝিল হাফপ্যান্টপরা এক মফস্বল কিশোরের মতো” – এই তুলনার মাধ্যমে কবি শহরের সরল ও নির্মল অতীত স্মৃতিকে ধারণ করেছেন। “ব্রতহীন পথ” রূপকটি জীবনযাত্রার অর্থহীনতা এবং দিকনির্দেশনার অভাবকে নির্দেশ করে।

কবির উদ্দেশ্য ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য

আবিদ আজাদ এই কবিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত শোককে সর্বজনীন রূপ দিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ নয়, বরং সমগ্র শহুরে জীবনের অর্থান্বেষণ। কবিতাটির ভাষা অত্যন্ত চিত্রময় এবং আবেগঘন, যেখানে দৈনন্দিন শহুরে বস্তু ও স্থানগুলো গভীর দার্শনিক অর্থ লাভ করেছে।

আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

কবিতাটিতে শোক, একাকিত্ব, স্মৃতির বেদনা, এবং অস্তিত্বের সংকটের গভীর চিত্রণ রয়েছে। কবির “দেখতে-দেখতে যাই… বহুদিন পর আমি এইভাবে কিছুই দেখি না” – এই পংক্তিতে একটি গভীর বিষন্নতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। কবির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এখানে অস্তিত্ববাদী সংকটের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে তিনি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার সীমারেখা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন।

স্থান ও সময়ের চিত্রণ

কবিতাটিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানের উল্লেখ রয়েছে – রমনা পার্ক, ন্যুমার্কেট, বুড়িগঙ্গা নদী, কার্জন হল, পাবলিক লাইব্রেরি প্রভৃতি। শীতকালীন ঢাকার বর্ণনা কবিতাটির ম্লান ও বিষন্ন আবহকে আরও তীব্র করেছে। সময়ের এই চিত্রণ কবিতাটিকে একটি নির্দিষ্ট historical context দিয়েছে।

মেটা ডেসক্রিপশন

আবিদ আজাদের “এলিজি : আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে” কবিতার পূর্ণ বিশ্লেষণ। কবিতার রূপক, প্রতীক, আবেগ এবং দার্শনিক দিক নিয়ে গভীর আলোচনা। আবুল হাসানের স্মৃতিতে রচিত এই শোকগাথার সাহিত্যিক মূল্যায়ন।

FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)

কবিতাটির প্রধান বিষয়বস্তু কী?

কবিতাটির প্রধান বিষয়বস্তু হলো মৃত্যু, শোক, স্মৃতি এবং শহুরে জীবনের একাকিত্ব। কবি আবুল হাসানের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে সমগ্র ঢাকা শহরের এক আত্মিক শূন্যতাকে চিত্রায়িত করেছেন।

কবিতাটিতে কোন কোন সাহিত্যিক কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে?

কবিতাটিতে রূপক, প্রতীক, উপমা, বাক্যচ্ছন্দ এবং চিত্রকল্পের অভিনব ব্যবহার দেখা যায়। শহরকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে চিত্রায়ন করা হয়েছে এবং দৈনন্দিন বস্তুগুলোকে গভীর দার্শনিক অর্থে ভরা হয়েছে।

কবিতাটির শিরোনামের তাৎপর্য কী?

“এলিজি” হলো এক ধরনের শোকগাথা কবিতা। শিরোনামটি নির্দেশ করে যে এটি কেবল একটি সাধারণ কবিতা নয়, বরং একজন প্রিয় মানুষের স্মৃতিতে রচিত শোকসংগীত।

কবিতাটিতে ঢাকা শহর কীভাবে উপস্থাপিত?

ঢাকা শহর এখানে একজন শোককারী মানুষের রূপক। শহরের ইট-পাথর, দালান-কোঠা, রাস্তাঘাট সবই কবির শোক ও একাকিত্বের অংশীদার হয়ে উঠেছে।

কবিতার কেন্দ্রীয় প্রতীক

পথ, দূরত্ব, আলো-অন্ধকার, নির্মাণসামগ্রী – এসব প্রতীক কবিতাটির কেন্দ্রীয় ভাবনা বহন করে। পথ হলো জীবনের যাত্রাপথ, দূরত্ব হলো মৃত্যু ও জীবনের মধ্যকার ব্যবধান, আর নির্মাণসামগ্রী হলো শহুরে সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী।

সাহিত্যিক গুরুত্ব

এই কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতায় শহুরে জীবন ও অস্তিত্ববাদী চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আবিদ আজাদ তার স্বতন্ত্র শৈলীতে ব্যক্তিগত শোককে সর্বজনীন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।

© Kobitarkhata.com – কবি: আবিদ আজাদ | কবিতার প্রথম লাইন: “তুমি নেই বলে ঢাকাও দুঃখ পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে ইটের গাঁথুনি”

তুমি নেই বলে ঢাকাও দুঃখ পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে ইটের গাঁথুনি
গাঁথুনির জমা চুন, পাথরে-লোহায় জড়াজড়ি সুরকি-কাঁকর
সিমেন্টের মায়ামমতার ভিতরে জীবন, জীবনের ভিতরে মৃত্যুর কীট,
ভেন্টিলেটরের ফাঁক-ফোকর, অন্ধকার

আর প্রাণ, কষ্টের দুহাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে
শহরের পুরানো দালানকোঠা, মতিঝিল হাফপ্যান্টপরা এক
মফস্বল কিশোরের মতো কেবলি আকাশ তার নীল করে দিতে থাকে আমি দেখি…
দেখতে-দেখতে যাই… বহুদিন পর আমি এইভাবে কিছুই দেখি না

বনানী হয়তো খুব দূরে নয়, দূরের ব্যাপার কিছু নয়
এইভাবে দূরত্বকে দেখি আজ… দেখি কেউ নেই…
এত দূরে তুমি… সত্যি-সত্যি তুমি চলে গেছ? নাকি আছ? আছ….?
এইসব খুদকুঁড়ো সকল প্রশ্নের মৌন শুধু
কেবল জীবিতদের পাতার ভিতরে ছায়াদের নড়াচড়া।

ঢাকায় এখন শীতকাল, বিকেলবেলায় থান-থান ভয়েল রৌদ্রের সাথে
রমনার গাছগুলি তাঁতিদের মতো নিজেদের সব তাঁত ছড়িয়ে-ছড়িয়ে চলে যায়
ছায়া পড়ে… এমন নিঝুম অন্যমনস্কতা… মনে হয় ছিলে… কোনোদিন
নেই আর… শুধু এই
থাকা না-থাকার মাঝে ঘুচে গেছে ব্রতহীন পথ…

অথবা ছিল না কোনো পথ, ছিল শধু পথহাঁটা
কখনো চোলাই জ্যোৎস্নায় চকচকে পিচের রাস্তা
কচ্ছপের পিঠ, কখনো নির্মম কাত হয়ে পড়া
তেরছা বৃষ্টির মধ্যে ক্রিমসন কালারের গাড়ি সন্তান প্রসব করে রেখে যায় নির্জন ফুটপাতে,
ফসফরাস জ্বলে ফুলার রোডের তলপেটে, র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের দোতলায়,
সুগোল তরল তেল ভাসা দেবদারুদের সাঁওতালি ছায়ায় নিস্তরঙ্গ অশরীরী
এইসব পথ বহুদিন খেয়ে গেছে আমাদের স্যান্ডেলের তলা
আমাদের দুঃখ, আমাদের ভবঘুরে স্বপ্ন।

এইভাবে আজ আমি পথের নিকটতম মানে খুঁজি
আছে নাকি কোনো মানে? ‘নিকট’, ‘নিকটতম’ এরকম কোনো
শব্দ আজো দরকার হয় নাকি তোমার নিজের?
আমাদের হয়।

আমাদের কাছে তবু এখনো পথের মানে আছে
দূরত্বের মানে আছে মাঠের মতন
আমরা সকলে আজো এইসব মাঠের ভিতরে
তুমি নও।

তাছাড়া সবই ঠিক আছে…
মানুষ, পুলিশ, এম্বুলেন্স, মাতাল তরুণ কবি, ভালবাসা
বেইলি রোডের সুনসান গলা, নিঝুম ঝাঁঝালো কোকাকোলা
দেশে ফেরা জাহাজের কাপ্তানের মতো ফিরে পাওয়া আমার প্রতিটি উদ্গ্রীব বুধবার
কবিতার পুঁজে-রক্তে চিল্লাচিল্লি-ফাটে বিষফোঁড়া
এইসব… এইসব… সবই আগের মতো ঠিকঠাক মিটারের গ্লানি নিয়ে চলে
ইঞ্জিনের ব্যথা নিয়ে ব্যথা ঘষে ঘষে তবু হাঁটে,
বসে থাকে। ইউক্যালিপটাসের গাছ, কার্জন হলের লাল মুখচ্ছবি
পাবলিক লাইব্রেরি, কাঠবাদামের ছায়া, তক্ষকের ডাক
ছন্নছাড়া লাগে… বাউন্ডুলে লাগে খুব
ঢাকায় এখন শীতের সিজন প্রায় শেষ বলে ধীরে-ধীরে পশমের রং বদলের দিন শুরু হয়ে গেছে
আমি দেখি… দেখতে-দেখতে যাই… বহুদিন পর আমি এইভাবে কিছুই দেখি না।

মনে হলো কুয়াশার মধ্যে একটি কাঠঠোকরা পাখি
ঘাই মেরে এসে ঢুকে গেল নিজের বুকের সমাপ্ত খোঁড়লে
তাই দেখে ঠোঁটে অভিমান নিয়ে গোল আংটির মতো ন্যুমার্কেট কেবলি সন্ধ্যায়
মলিন আলোয় ম্লান হয়,

ম্লানতায় ডুবে যায় বাকল্যান্ড, বুড়িগঙ্গা, টার্মিনাল আর
বিষণ্ন একটি তারা চাঁদের হাঁটুর কাছে পুড়ে যেতে থাকে।

সে-ও দূরে… মানুষের মতো, কেবল জীবিত মানুষের মতো একা…একা…।

আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। আবিদ আজাদ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x