আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার ময়লা জামাকে,
শোনো বলি চুপি চুপি
আমার উলের রঙিন টুপি
দিতো মাথায় ফাঁক পেলেই,
হাসতো তখন দাঁত মেলেই।
আসতো চিঠি মুক্তো হাতের
আসাতো হাসি জ্যোৎস্না রাতের
সব মেলেই।
আমার বাবা বাসতো ভালো দেশটাকে,
শ্যামল পরিবেশটাকে,
সবার চেয়ে প্রিয় ছিলো তাহার
টেবুল বোঝাই মুখরোচক আহার।
আমার বাবা আজব মানুষ,
তাহার কাছে প্রিয় মানুষ,
শাদা, কালো, হলুদ, লাল,
থ্যাবড়া নাক, গোল কপাল,
বাংলা ভাষী, উর্দু ভাষী,
বাসায় হতো ঠাসাঠাসি
দেশবিদেশের লোকের সাথে
আড্ডা দিতো দিনে রাতে,
আমার বাবা কেমনতরো মানুষ?
আমার বাবা বাসতো ভালো মানুষ।
মুদীর ছেলে হুমায়ুনে
বশ হলো তার আজব গুণে,
কাজী পাড়ার শান্তি ধোপা,
গোলাপীর মা’র দারুণ চোপা,
রিকশাচালক সমীরুন্দি,
মধ্যপাড়ার কানু বদ্যি,
ত্রস্ত ব্যস্ত কাগজঅলা
আলাপ জমায় বাড়িয়ে গলা
মিহিন সুরের গোয়ালিনী
বাজিয়ে চুড়ি রিনিঝিনি
আলাপ জমায় আছে কি হুঁশ?
আমার বাবা আজব মানুষ।
আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার মাকে, মামাকে,
পরী আপার উঠলে কথা
গুলিয়ে যেতো বুড়োর কথা;
আমার দু’বোন আজম ভাইতে
দ্বন্দ্ব হতো কে কার চাইতে
আদর পেলো বাবার কাছে
সে সব রিপোর্ট আমার আছে।
গণি ভাইকে ডাকতো বুড়ো ‘আবদুল গণি’
সে ছিলো তার শেষ বয়সের চোখের মণি।
এটুক বুঝি বাসতো ভালো আমাকে
এমন কি মোর জামাকে
এমন কি মোর বন্ধু-বান্ধব
ছাত্র-ছাত্রী, গোলাপের টব,
চেয়ার টেবুল, রাকের বই,
জুতো, ছাতা, কতো কি কই
যাহা ছিলো আমার
চাকরি কিংবা খামার
সবই অতি প্রিয় ছিলো বাবার
বুড়ো বাবার।
আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। আসাদ চৌধুরী। 
আমার বাবা – আসাদ চৌধুরী | বাংলা কবিতার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা
কবিতার সারাংশ
আসাদ চৌধুরীর “আমার বাবা” কবিতাটি পিতা সম্পর্কে এক গভীর অনুভূতিপূর্ণ চিত্র। এখানে কবি তাঁর বাবার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্মৃতি এবং মানবিক সম্পর্কের উষ্ণতা তুলে ধরেছেন। কবিতার শুরুতেই সন্তানসুলভ স্নেহের প্রকাশ— “আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে”—এই এক লাইনেই পিতৃত্বের মর্মার্থ প্রকাশ পায়। কবি শুধু পিতাকে নয়, তাঁর জীবনদৃষ্টি, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানবপ্রেমকেও তুলে ধরেছেন।
বিষয়বস্তু ও মূল বার্তা
কবিতার প্রতিটি স্তবক যেন একটি ছোট গল্প। এখানে পিতা শুধু পারিবারিক মানুষ নন, বরং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের বন্ধু। তিনি যেমন মুদির ছেলে হুমায়ুনের সঙ্গে কথা বলেন, তেমনি রিকশাচালক, ধোপা বা সংবাদবিক্রেতার সাথেও সহজভাবে মিশে যান। এই বৈচিত্র্যময় সম্পর্কের মধ্য দিয়েই কবি দেখিয়েছেন—মানুষের শ্রেণি, জাত, বা পেশা নয়, ভালোবাসাই মানুষকে মানুষ করে তোলে।
কবিতার ভাষা ও সাহিত্যধারা
“আমার বাবা” কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এখানে কথ্য ভাষা, ছন্দহীন কিন্তু প্রাঞ্জল বাক্যগঠন, এবং বাস্তব জীবনের দৃশ্যগুলোকে কবি এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন পাঠক নিজের জীবনের বাবাকে দেখতে পান। এটি একাধারে জীবনঘনিষ্ঠ ও আবেগঘন। সাহিত্যধারায় এটি বাস্তববাদী ও মানবিক ধারা অনুসরণ করে।
রূপক ও প্রতীক বিশ্লেষণ
এই কবিতায় “রঙিন টুপি”, “ময়লা জামা”, “চিঠি”, “জ্যোৎস্না রাত” ইত্যাদি প্রতীক হয়ে উঠেছে স্মৃতির, ভালোবাসার ও সময়ের প্রতিনিধিত্বকারী চিহ্ন। পিতার হাসি, তার ছেলেমানুষি আচরণ কিংবা সামাজিক বন্ধুত্ব—সব কিছু মিলিয়ে কবি আমাদের চোখের সামনে এক প্রাণবন্ত মানুষকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে ‘বাবা’ মানে কেবল একজন ব্যক্তি নয়, বরং মানবতার প্রতীক।
আবেগ ও মানসিক অনুরণন
কবিতার আবেগ গভীর কিন্তু মৃদু স্রোতের মতো প্রবাহিত। কোথাও কান্না নেই, অভিযোগ নেই; আছে শুধু শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর স্মৃতির মৃদু ব্যথা। পাঠকের মনে এই কবিতা এমন এক নরম জায়গায় হাত রাখে, যেখানে আমরা নিজের বাবার মুখ মনে করি। কবি বলেন, “আমার বাবা কেমনতরো মানুষ?”—এই প্রশ্নের ভেতরেই আছে হাজারো আবেগের উত্তর।
কবিতার সামাজিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি
আসাদ চৌধুরীর এই কবিতায় একদিকে যেমন পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা আছে, তেমনি সমাজে মানুষে মানুষে সমতার বার্তাও আছে। পিতার চরিত্রের মাধ্যমে কবি দেখাতে চেয়েছেন—ভালোবাসা শ্রেণি, ধর্ম, বা জাতের গণ্ডি মানে না। এই মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই কবিতাটিকে সময়াতীত করে তুলেছে।
সাহিত্যিক মূল্য ও প্রভাব
“আমার বাবা” শুধু একটি পারিবারিক কবিতা নয়, এটি বাংলা সাহিত্যে পিতা-পুত্র সম্পর্কের এক আবেগময় দলিল। এর সরলতা ও আন্তরিকতা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। আধুনিক বাংলা কবিতায় পিতার প্রতি এমন মমতাভরা শ্রদ্ধা খুব কম দেখা যায়। কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে মানবিকতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
মেটা বর্ণনা
বাংলা কবিতা “আমার বাবা – আসাদ চৌধুরী”র বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা। পিতার প্রতি ভালোবাসা, স্মৃতি ও মানবিকতার এক মায়াময় কবিতা। SEO-উপযোগী বিশ্লেষণ।
FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)
  
    “আমার বাবা” কবিতার মূল থিম কী?
    
      এই কবিতার মূল থিম পিতা-পুত্র সম্পর্ক, মানবতা এবং ভালোবাসার সার্বজনীনতা।
     
   
  
    কবিতার সাহিত্যধারা কী?
    
      এটি আধুনিক বাংলা কবিতার বাস্তববাদী ও মানবিক ধারার অন্তর্ভুক্ত।
     
   
  
    কবিতার প্রতীকী উপাদানগুলো কী কী?
    
      রঙিন টুপি, ময়লা জামা, চিঠি ও জ্যোৎস্না রাত—সবই স্মৃতি ও স্নেহের প্রতীক।
     
   
 
© Kobitarkhata.com | ফোকাস কীওয়ার্ড: আমার বাবা আসাদ চৌধুরী কবিতা, বাংলা আবেগঘন কবিতা, পিতার প্রতি শ্রদ্ধার কবিতা