কালো মেয়ে – শ্বেতা চক্রবর্তী।

গোটা দেশ তোমায় বলেছিল,এই গায়ের রঙে চলবে না,
বলেছিল মাসিমা,কাকিমা,পিসিমা,
এমনকি তোমার মা,তোমার বাবা;

বলেছিল,’এক পোঁচ,দু পোঁচ ময়দা মেখে নে,একটু রূপটান,
একটু ফর্সা না হলে মেয়েদের চলে নাকি?
বাইরের হিমরাত তোমার কালো ঢাকতে পারবে না!

বলেছিল সক্কলে,গায়ে কিছু জড়াও,
মেয়েমানুষের অত রাগ কিসের শুনি?
অমন হুটহাট বেরিয়ে পড়া অস্থানে কুস্থানে!
অমন রাতবিরেতে!
সবাই তর্জনী তুলে বলেছিল,এসব চলবে না!
মেয়েরা মেয়েদের মতো না হলে প্রশংসা পায় না,পুজো পায় না!

তুমি সটান ঢুকে পড়েছিলে শ্মশানে,
ডাকিনী আর যোগিনী নামের
দুটো বীভৎস চেহারার মেয়ের সঙ্গে মেতেছিলে উন্মাদ নৃত্যে!

কয়েকটা ধর্ষক সবে তখন ধর্ষণ শেষে বিড়ির সুখটান নিচ্ছে,
গাঁজার ধোঁয়ায়,বিটকেল গন্ধে আচ্ছন্ন হচ্ছে মহাশ্মশান,
তুমি কিছু না মেনে খড়্গ তুলেছিলে ওদের দিকে,
ওরা কিছু বোঝার আগেই ওদের মুণ্ডু তোমার গলায় পরে নিয়েছ!

তারপর এই তিনটে কালো মেয়ের হাসি দেখেছিল ত্রিভুবন!
কেঁপে উঠেছিল কাপালিকদের আখড়া,
কেঁদে উঠেছিল তোমারই চেনা শিশুরা!

শেয়ালেরা দল বেঁধে পিছু নিয়েছিল তোমাদের,
তিনটে কালো নারী তিনটে নীল অপরাজিতা ফুলের
মতো দুলতে দুলতে জগৎ ছেয়ে ফেলছিল,
সবাই স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল,
কালো নারীর অপরিসীম ক্ষমতা!

বিয়ের পর তুমি মাঝেমাঝেই ঘোরা রাগে উন্মাদিনী,
দেহে বসন নেই,
অত্যাচারী মানুষদের শাস্তি দিতে ছুটে বেড়াচ্ছিলে নিমতলায়,
একটা যাজ্ঞসেনী আলোর মতো অন্ধকালে ঝলসে উঠছিল তোমার কালো রঙ!
সবাই একজোট হয়ে বারণ করছিল,
স্বামীও এসে শুয়ে পড়েছিল তোমার পথরোধ করবে বলে,
তুমি অপরিসীম যন্ত্রণায় আত্মবিস্মৃতর মতো
স্বামীর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে জিভ কেটেছিলে,
তোমার জিভ চুঁয়ে রক্ত পড়ছিল,
কারণ,তখন তুমি মহাকালী!
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অসহায়তা তুমি শোষণ করছ নিজ দেহে!
ঠিক যেমন আমাদের পাড়ার মাথা উঁচু
কালো মেয়েটা,নাম কাঙ্ক্ষিতা,যাকে কেউ আকাঙ্ক্ষা করে নি,
যে কেবল নিজের জোরেই নিজের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিতা,
সেই মেয়েটাও যেদিন তার দুটি বান্ধবীর পেছনে
টিটকিরিরত দুটো ছেলেকে ভয়ানক পিটিয়ে ঘরে ফিরে
নিজের নখের ডগায় দেখেছিল ওই দুটি ছেলের বদরক্ত,

ঠিক তেমনি,তুমি,কালো মেয়ে আগুনের মতো জ্বলছিলে,
আগুন কি কালো হয়?
আগুনের বুকের কাছে কালো হয়,
সলতের জ্বলন কালো হয়,
আগুন কালো হয়,সেভাবেই।

অবশেষে তোমার বিয়ের পর বছর বছর চলে গেল,
সন্তান কেন হবে না?কেন?কেন?কেন?
গোটা সমাজ আবার তোমায় ছিন্নভিন্ন করলো,
তুমি হেসে উঠেছ,কষ্ট পেয়েছ,
কিন্ত সারাটা জীবন সন্তানবতী না হয়ে,
সারাটা জীবন কালো রঙের ওপর সাদা রঙ না লেপ্টে,
সারাজীবন নিজের খুশিতে হিমের রাতে এপার ওপার করেছ
নিজের স্বপ্ন,নিজের মহতী সম্ভাবনাকে।

যে দেশে প্রতিটা মা মেয়ে হলেই চেয়ে দেখে ফর্সা হল কিনা,
যে দেশে প্রতিটা মা কালো কন্যাকে সাজাতে চায় সাদা পাওডারে,
যে দেশে সব মা চায়,কন্যা গোছানো সংসারী,নম্র,সন্তানবতী,লক্ষ্মীমন্ত হোক্,

সে দেশেই,তুমি,কালো মেয়ে সন্তান,স্বামী,ঘর,দুয়ারের
তোয়াক্কা না করে কাটালে কী ভীষণ নিজের মতো!
নিজের মতো শরীরে,সাধে,নিজের মতো স্বপ্নে,স্বেচ্ছাচারণে,

নিজেরই মতো কেবল নিজের জীবনের একতম শর্তে
আশ্চর্য সীমাহীনা কালী,কালিকা।

আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। শ্বেতা চক্রবর্তী।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x