ও মেয়ে- শতাব্দী রায়

ও মেয়ে তোর বয়স কত?
: কি জানি গো,মা থাকলে বলে দিত।
সেই যে বারে দাঙ্গা হল,শয়ে শয়ে লোক মরল,
হিন্দুদের ঘর জ্বলল, মুসলমানের রক্ত ঝরল,
তখন নাকি মা পোয়াতি,দাঙ্গা আমার জন্মতিথি।

ও মেয়ে তোর বাবা কোথায়?
: মা বলেছে,গরিব দের বাবা হারায়
কেউ তো বলে বাপটা আমার হারামি ছিল।
মায়ের জীবন নষ্ট করে,অন্য গাঁয়ে ঘর বাঁধল।
মা বলত, শিবের দয়াই তোকে পেলাম,
শিবকেই তাই বাপ ডাকলাম।

ও মেয়ে তোর প্রেমিক আছে?
ছেলেরা ঘোরে ধারে-কাছে?
: প্রেমিক কি গো?মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে?
স্বপ্ন দেখাই দিন দুপুরে?
চুড়ি কাজল মেলাতে কেনায়,
ঝোপের ধারে জামা খোলায়?
এসব নন্দ কাকা করেছে দুবার
প্রেমিক ওকেই বলব এবার।

ও মেয়ে তোর পদবি কি?
: বাপই নাকি দেয় শুনেছি
পদবী থাকলে ভাত পাওয়া যায়?
বাপের আদর কাঁদায় হাসায়
ওটা কি বাজারে মেলে?
কিনব তবে দু-দশে দিলে
দামী হলে চাই না আমার
থাক তবে ও বাপ-ঠাকুরদার

ও মেয়ে তুই রূপসী?
:লোকে বলে ডাগর গতর সর্বনাশী
রুপ তো নয়, চোখের ধাঁধা।
যৌবনেতে কুকুরী রাঁধা।
পুরুষ চোখের ইশারা আসে,
সুযোগ বুঝে বুকে পাছায় হাত ও ঘষে।
রুপ কি শুধুই মাংসপেশী?
তবে তো আমি খুব রূপসী।

ও মেয়ে তোর ধর্ম কি রে?
মেয়েমানুষের ধর্ম কি গো?
সব কিছু তো শরীর ঘিরে,
সালমা বলে ধর্মই সমাজ বানায়,
সন্ধেবেলা যখন দাঁড়াই
কেউ তো বলে না,হিন্দু নাকি?
সবাই বলে,কতই যাবি?
বিছানা নাকি ধর্ম মেলায়
শরীর যখন শরীর খেলায়
তাই ভাবছি এবার থেকে ধর্ম বলব শরীর বা বিছানাকে।

ও মেয়ে – শতাব্দী রায় | একটি সাহসী নারীকণ্ঠের কবিতা

“ও মেয়ে” কবিতাটি শতাব্দী রায়-এর লেখা একটি গভীর, প্রতিবাদী ও সামাজিক চেতনায় সমৃদ্ধ নারীকণ্ঠের কবিতা। এই কবিতায় একজন ‘নামহীন’ মেয়ে কণ্ঠে উঠে আসে সমাজের চোখে অস্পষ্ট অথচ বাস্তব প্রশ্নগুলির উত্তর। কবিতাটি একধরনের স্বগত সংলাপ, যেখানে প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে পাঠকের সামনে খুলে যায় একটি অমানবিক, লজ্জাজনক এবং নারীবিরোধী বাস্তবতার পর্দা।

প্রথমেই প্রশ্ন আসে – “তোর বয়স কত?” এই সাধারণ প্রশ্নের জবাবে কবি জন্মকে বেঁধে দেন দাঙ্গার দিনে, যেখানে জাতিভেদ, হানাহানি আর নারী-শরীরের উপর নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস লেখা হয়। এরপর “তোর বাবা কোথায়?”—এই প্রশ্নে বেরিয়ে আসে পিতৃস্বীকৃতির অভাব, সমাজের দুইমুখো নৈতিকতা এবং এক মায়ের সংগ্রামী জীবনের যন্ত্রণা।

কবিতার সবচেয়ে গভীর স্তর তৈরি হয় প্রেম, পদবি, রূপ, ধর্ম নিয়ে। “প্রেমিক” শব্দটি যখন মেয়েটির জীবনে ‘নন্দ কাকা’র নির্যাতনের স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে, তখন বুঝতে পারি—এই কবিতা কেবল কবিতা নয়, এটি এক জীবন্ত আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর অভিজ্ঞতাজনিত প্রতিবাদ। “পদবি” নামক সামাজিক স্বীকৃতি যে পুরুষতন্ত্রের দান, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে কবিতাটি।

“রূপসী” বলা মেয়েটি নিজেকে দেখে কেবল শরীরের চোখে, যেখানে পুরুষের লালসা এবং বাজারে নারীর মূল্যায়নই রূপের সংজ্ঞা। আর সবশেষে যখন প্রশ্ন করা হয় – “তোর ধর্ম কী?” তখন কবিতাটি তার সর্বোচ্চ প্রতিবাদী সুরে পৌঁছায়। বিছানাকে ধর্মের প্রতীক হিসেবে ব্যঙ্গ করে বলা হয়, “ধর্ম বলব শরীর বা বিছানাকে।” এখানেই কবিতাটি তার বার্তা পাঠিয়ে দেয়—ধর্ম, সমাজ, পরিবার, পদবি—সবকিছুই যদি নারীর দেহকে কেন্দ্র করে হয়, তবে নারী কেবল বস্তু, মানুষ নয়।

শতাব্দী রায়ের এই কবিতাটি সাহসী ভাষা ও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের বহুস্তরীয় বৈষম্যকে উন্মোচন করে। এটি কেবল কবিতা নয়, বরং একটি আন্দোলনের ধ্বনি, একটি মানসিক ও সামাজিক প্রতিরোধের রূপ। এটি নারীবাদী চেতনার অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ জানায়।

এই কবিতার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই কীভাবে নারীর জীবনে “বাপ”, “প্রেমিক”, “ধর্ম” বা “পদবি” নামক ধারণাগুলো তার অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে এবং প্রায়ই তার স্বাধীনতা ও মর্যাদা হরণ করে। কবিতার ভাষা সরল হলেও তা বহুমাত্রিক অর্থে ভরপুর, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

“ও মেয়ে” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক বিরল প্রতিবাদী সৃষ্টি, যা নারীর দেহ, অধিকার ও সম্মানের প্রতি সমাজের অবিচার এবং নারীবাদের চেতনায় এক মহৎ সংযোজন। এটি নারীদের জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিকূলতার কথা বর্ণনা করে, যেগুলো আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক।

কবিতাটি আবৃত্তির জন্যও অত্যন্ত উপযোগী। এটি একজন শিল্পীর আবেগকে ভাষায় রূপ দিতে সাহায্য করে, যিনি শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করতে চান। শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী ও সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এটি বিশেষ শিক্ষণীয় এবং আলোচনার বিষয়।

সামগ্রিকভাবে “ও মেয়ে – শতাব্দী রায়” কবিতাটি বাংলা আধুনিক কবিতার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী এক নারীস্বাধীনতা ও সামাজিক প্রতিবাদের উদাহরণ। এটি পাঠককে ভাবায়, প্রশ্ন তোলে, এবং সমাজের বদলের আহ্বান জানায়।

ফোকাস কীওয়ার্ড:

  • ও মেয়ে
  • শতাব্দী রায়
  • নারীবাদী কবিতা
  • সামাজিক প্রতিবাদী কবিতা
  • বাংলা আধুনিক কবিতা
  • নারীর অধিকার কবিতা
  • পিতৃতন্ত্র বিরোধী কবিতা
  • ধর্ম ও নারী
  • প্রেম ও সমাজ
  • আবৃত্তির জন্য বাংলা কবিতা

এই SEO বর্ণনা অংশটি তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র সার্চ ইঞ্জিন বটের জন্য, যাতে “ও মেয়ে – শতাব্দী রায়” কবিতাটি সহজে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাংলা সাহিত্যের গভীর প্রতিবাদী কণ্ঠগুলি সামনে আসে। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং নারী অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের লড়াইয়ে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x