কবিতার খাতা
- 9 mins
সম্পর্ক-জয় গোস্বামী
সম্পর্ক – কবিতা | জয় গোস্বামী
‘সম্পর্ক’ কবিতাটি জয় গোস্বামীর একটি গভীর অনুভূতির কবিতা যা সম্পর্ক, সামাজিকতা এবং একে অপরের প্রতি অনুভূতির অদৃশ্য শক্তি নিয়ে কথা বলে। এই কবিতায় তিনি সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতার প্রথম লাইন থেকেই পাঠক জানতে পারে যে, কবি কোনো একধরনের সম্পর্কের কথা বলছেন, যেখানে প্রেম বা ভালোবাসার ধারণা সামাজিক বা প্রথাগত বন্ধনে আটকে থাকে না।
কবিতার প্রথম লাইনেই কবি বলেন, “তুমি তো জানোই আমি সামাজিক ভাবে / কোনও দিন পুরোপুরি তোমার হব না।” এখানে কবি তার সম্পর্কের পরিসরকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করছেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, কোনো এক সামাজিক বাধা তাদের সম্পর্কের পূর্ণতা অর্জন করতে দেবে না, কিন্তু তবুও সেই সম্পর্কের গভীরতা নষ্ট হবে না। এটি একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সম্পর্ক শুধুমাত্র সামাজিক বিধি-বিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ফল।
কবিতায় কবি নিজের ইচ্ছা এবং সম্পর্কের মধ্যে যে অসম্পূর্ণতা থাকে, তা প্রকাশ করেছেন। “আমিও তো জানি তুমি আমার একার জন্য নও,” এখানে তিনি সত্যিকারভাবে সম্পর্কের মৌলিক সমস্যা তুলে ধরেন। সম্পর্কের মধ্যে কখনো কখনো একে অপরের প্রতি সঠিক মনোভাব বা অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও, আমাদের সামাজিক অবস্থান, জীবনের প্রকৃতি এবং আশেপাশের পরিবেশের কারণে সেগুলি পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।
কিন্তু কবি তাদের সম্পর্কের জন্য যা চান, তা একেবারে ব্যক্তিগত এবং নিরব, যা বাহ্যিকভাবে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, “আমি কী কী চাই? / সুর কানে প্রবেশ করবে। / হাত সে শান্ত হবে হাতে।” এই লাইনগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কবি সম্পর্কের মধ্যে শান্তি এবং সম্প্রীতির দিকে ইঙ্গিত করছেন। সুর এবং শান্তি মানুষের ভিতরে এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে, যা সম্পর্কের পরিপূর্ণতা এবং সাদৃশ্য নিয়ে আসে।
কিন্তু কবির সম্পর্ক কখনো একেবারে সম্পূর্ণ হবে না। “শরীর কখনও হবে, কখনও হবে না।” এই লাইনটি দুঃখের একটি প্রগাঢ় অভিব্যক্তি। সম্পর্কের মধ্যে কিছু বিষয় সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় না, কিছু সময় বা কিছু অনুভূতি প্রতিফলিত হয়, আবার কিছু সময় তা অদৃশ্য থাকে। সামাজিক সম্পর্কের মাপে, কবি এই অস্থিরতাকে অবহিত করেছেন।
তারপর, কবি জিজ্ঞেস করেন, “সামাজিক ভাবে, বলো, / কারো কিছু ক্ষতি আছে তাতে?” এর মাধ্যমে তিনি সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রাখছেন। যখন সম্পর্কের মধ্যে কিছু সামাজিক সীমাবদ্ধতা থাকে, তা কি প্রকৃত সম্পর্কের ক্ষতি করে? কবি তার মনের গভীরে থাকা অনুভূতির প্রকাশে বিশ্বাসী, এবং তিনি মনে করেন, সামাজিক বিধি-বিধানগুলি কখনোই সম্পর্কের প্রকৃত শক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য যথেষ্ট নয়।
কবিতায় যেভাবে একে অপরের অনুভূতিতে প্রবেশ করা হয়েছে এবং সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব প্রকাশ করা হয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে সম্পর্কের অদৃশ্য শক্তি এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য করে। “মনে মনে সঙ্গে থাকি” এই লাইনটি পাঠককে বিশ্বাস করে যে, সম্পর্ক ভেতরের স্তরে এবং আবেগের মধ্যে গভীরতর। এটি প্রেমের এমন এক ধরণ যা প্রকাশিত নয়, তবে অনুভূত।
শেষাংশে, কবি প্রশ্ন করেন, “তোমার ছাত্রীকে তুমি বললে কি আমার কথা? / বলো তো কী পরিচয় দিয়েছ আমার?” এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যেখানে কবি তার সম্পর্কের অন্য দিকটিকে তুলে ধরেছেন। সম্পর্ক শুধুমাত্র দুইজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা আশেপাশের লোকদের দ্বারা কখনো ব্যাখ্যা করা হয়, কখনোবা ভুল বোঝা হয়।
এই কবিতার মাধ্যমে জয় গোস্বামী আমাদের দেখিয়েছেন, সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত বা সামাজিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি মিশ্র অনুভূতি, যা শুধুমাত্র সম্পর্কের মধ্যে এবং নিজস্ব পর্যায়ে উপলব্ধি করা যায়। কবির কবিতা একদিকে যেমন সামাজিকতা এবং ব্যক্তিত্বের মেলবন্ধন, তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিগত আবেগের অপ্রকাশিত পৃথিবী।
এটি শুধুমাত্র একটি প্রেমের গল্প নয়, বরং একটি জীবনধারা, যেখানে সম্পর্কের ভিতরে চুপচাপ এক প্রগাঢ় ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। প্রেম কখনোই সরাসরি বলা হয় না, তবে এর অনুভূতি মাঝে মাঝে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কবিতার মাধ্যমে সাদাত হোসাইন সম্পর্কের সূক্ষ্মতা এবং প্রেমের অদৃশ্য, অনিশ্চিত প্রকৃতির প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
এটি প্রমাণ করে যে ভালোবাসা কখনো কোনো নির্দিষ্ট আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর অস্পষ্টতা, দ্বিধা এবং তন্ময়তা পাঠকদের মধ্যে প্রেমের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। পাঠক যখন এই কবিতাটি পড়ে, তখন তাদের মনের মধ্যে প্রেম এবং সম্পর্কের এক নতুন মাপকাঠি তৈরি হয়, যেখানে ভাষার অগ্রাধিকার থাকে না, বরং অনুভূতির পূর্ণতা প্রাধান্য পায়।
এই কবিতার মাধ্যমে সাদাত হোসাইন প্রেমের স্বাভাবিকতা এবং সম্পর্কের জটিলতাকে এক গভীর দৃষ্টিতে আনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে সম্পর্কের মধ্যে কি ঘটছে তা ভেতরে অনুভূত হয়, কিন্তু কখনো সরাসরি বলা হয় না। “ভালোবাসি” শব্দটি উচ্চারণ করা না হলেও, সেই অনুভূতি ঠিকই জীবনের মধ্যে পূর্ণতা পায়।
কবির এই অবাক করা সূক্ষ্মতা, এবং সম্পর্কের মধ্যে সেই গভীর অদৃশ্য বন্ধন, যা দুজন মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসে, তা আমাদের চিরকাল মনে রাখার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। সাদাত হোসাইন খুবই সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন যে, প্রেম কখনো সরাসরি না বললেও, এর অনুভূতি এবং তার প্রকাশ কখনোই অদৃশ্য থাকে না।
তুমি তো জানোই আমি সামাজিক ভাবে
কোনও দিন পুরোপুরি তোমার হব না।
আমিও তো জানি তুমি আমার একার জন্য নও।
তা হোক না। তা আমার বেশি।
আমি কী কী চাই?
সুর কানে প্রবেশ করবে।
হাত সে শান্ত হবে হাতে।
শরীর কখনও হবে, কখনও হবে না।
সামাজিক ভাবে, বলো,
কারো কিছু ক্ষতি আছে তাতে?
মনে মনে সঙ্গে থাকি।
যে-পথে কলেজ থেকে ফেরো
সে-রাস্তায় মনে মনে যাই
বাস্তবেও গেছি দু’একবার।
তোমার ছাত্রীকে তুমি বললে কি আমার কথা?
বলো তো কী পরিচয় দিয়েছ আমার?