রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা চিঠি – তসলিমা নাসরিন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা চিঠি – তসলিমা নাসরিন

এই চিঠিটি তসলিমা নাসরিন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লিখেছেন, যেখানে কবির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং বিচ্ছেদের কষ্ট প্রকাশ করেছেন। কবির মৃত্যুর পর তসলিমা নাসরিন তার জীবনের অনেক স্মৃতি, অনুভূতি এবং প্রশ্ন নিয়ে লিখেছেন এই চিঠিটি।

কবিতার সারাংশ

এটি একটি আবেগপূর্ণ চিঠি যেখানে তসলিমা নাসরিন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যু এবং তার সঙ্গে সম্পর্কের নানা অনুভূতি নিয়ে কথা বলেছেন।

রূপক বিশ্লেষণ

চিঠিতে আকাশের মাধ্যমে রুদ্রকে এক অন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে, যা রুদ্রের মৃত্যুর পর তসলিমার অনুভূতিকে উজ্জ্বল করে তোলে। এখানে আকাশের সংজ্ঞা একজন মানুষের অশরীরী উপস্থিতি এবং শূন্যতার চিত্র।

কবির উদ্দেশ্য ও সাহিত্যধারা

এটি একটি স্বাভাবিক প্রবন্ধের মতোই তসলিমা তার নিজের অনুভূতি ও কবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। সাহিত্যধারায় এটি স্মৃতিচারণ ও অনুভূতির গভীরতা তুলে ধরে।

আবেগ বিশ্লেষণ

এই চিঠিতে তসলিমার ভাষায় এক গভীর বেদনা এবং নিজের দুঃখের প্রকাশ পায়, যা পাঠকের কাছে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি নিয়ে আসে।

মেটা ডেসক্রিপশন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা তসলিমা নাসরিনের চিঠি। কবির প্রতি তার ভালোবাসা, দুঃখ, স্মৃতিচারণ এবং বিচ্ছেদ নিয়ে গভীর অনুভূতির প্রকাশ।

FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)

তসলিমা নাসরিন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে কেন চিঠি লিখেছিলেন?

তসলিমা নাসরিন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর পর তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে এই চিঠিটি লিখেছিলেন।

চিঠির মূল অনুভূতি কী?

চিঠিটি একটি আবেগপূর্ণ স্মৃতিচারণ, যেখানে তসলিমা তার এবং রুদ্রের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন, তার মৃত্যুর পর এক গভীর শূন্যতা এবং বিচ্ছেদের কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে।

© Kobitarkhata.com – কবি: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রিয় রুদ্র,

প্রযত্নেঃ আকাশ,
তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে – হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।

আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে! সেদিন আমি টের পেয়েছি।

আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?

শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে … তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।

আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। “ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।

ইতি,
সকাল

পুনশ্চঃ আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি?

আরো চিঠ পড়তে এখানে ক্লিক করুন। তাসলিমা নাসরিন

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x