মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী।
সে চায়, তার মন খারাপ হলে প্রিয় মানুষটাকে না বললেও সে বুঝে ফেলুক।
ফোন করে খানিক ম্লান গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই
ওপারের মানুষটা বলুক, ‘তোমার মন খারাপ?’
তার এলোমেলো চুল, খানিকটা লাল চোখ দেখে বলুক ‘তোমার ঘুম হয় নি রাতে?
দুঃস্বপ্ন দেখছ? টেনশন করছ কিছু নিয়ে?’
সে চায়, মানুষটা বুঝুক কখন শক্ত করে
বুকের সাথে চেপে ধরতে হয়,
চোখের সামনে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে
বন্ধ করে দিতে হয় চোখের পাতা।
সে চায়, মানুষটা বুঝুক কখন হাতের মুঠোয় হাত রাখতে হয়
ফিসফিসিয়ে বলতে হয়, ‘আমি তো আছিই।
তবে মন খারাপ কেন?’
সে চায়, মাঝরাত্তিরে সে টের পাক,
পাশের মানুষটা তার মাথার নিচের সরে যাওয়া
বালিশটা ঠিক করে দিচ্ছে।
শেষরাতে যখন খানিক হিম নামে,
তখন জড়িয়ে দিচ্ছে ওম চাদরে।
সে চায়, তার জন্য মাঝরাত্তিরেও কেউ বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকুক।
মনে রাখুক তার জন্মদিনের কথা,
প্রথম দিনের কথা, স্পর্শ ও অনুভূতির কথা।
সে চায়, তাকে ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কেউ মিথ্যেমিথ্যি অজুহাত বানাক।
কেউ কপাল ছুঁয়ে বলুক, ‘দেখি, দেখি, তোমার জ্বর নয় তো?’
অভিমানে দূরে সরে যেতে চাইতেই কেউ বলুক,
‘খানিক ভুল করেছি বলেই দূরে সরে যেতে হবে?
তবে এই যে এত ভালোবাসি, তাতে আরও কাছে আসা যায় না?
আরও আরও কাছে? অনেক অনেক কাছে?’
মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী।
তারা দুজনই কেবল ভাবে, এসবই ওই মানুষটা করুক।
ওই অন্য মানুষটা। কিন্তু শেষমেশ করা হয় না কারোই।
তাই কাছে আসার রঙিন দিনেরা ক্রমাগত দূরে যাওয়ার ধূসর, বিবর্ণ গল্প হয়।
মানুষ বড্ড অভিমানী প্রাণী।
অভিমানে সে ক্রমশই দূরে চলে যায়,
বুকে পুষে রাখে এক সমুদ্র আক্ষেপ।
কবিতা: মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী
কবির নাম: সাদাত হোসাইন
প্রথম লাইন: মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী।
সাদাত হোসাইনের “মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী” কবিতাটি মানব মন ও আবেগের গভীরতার এক অনবদ্য প্রকাশ। এই কবিতায় মানুষের অভিমান ও ভালোবাসার মধ্যে যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব কাজ করে, তা সাদাকালো ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবিতার শুরুতেই বলা হয়েছে, মানুষ অভিমানী প্রাণী; মানে সে চায় তার মনের অবস্থা, তার দুঃখ, তার অজানা কষ্ট যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার প্রিয়জনের কাছে প্রকাশ পায়, তাও সে সরাসরি না বললেও।
কবিতায় নানা মূহূর্তের ছবি আঁকা হয়েছে—কখনো ফোনের ম্লান স্বরে ‘হ্যালো’ বলা মাত্রেই প্রিয়জন বুঝে ফেলে মন খারাপ হয়েছে, আবার কখনো ঘুম না হওয়া, দুঃস্বপ্ন, টেনশনের কারণ জানতে চাওয়া। এমনকি যখন কেউ পাশে থেকে আলতো করে চোখে হাত দিয়ে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, তখন মানুষটা বোঝে, সে একলা নয়, তার পাশে কেউ আছে। এই সূক্ষ্ম অভিব্যক্তিগুলো কবিতাকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
কবিতায় মাঝরাতের নীরবতা, বালিশ ঠিক করা, চাদরে জড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি মূহূর্তগুলো মানুষের মনের গভীরে থাকা নরম আবেগের কথা বলে। একজন মানুষের জন্য একজন অন্য মানুষের উপস্থিতি কতটা গুরুত্ব বহন করে তা স্পষ্ট করে। এমনকি জন্মদিন, প্রথম দিনের স্মৃতি, স্পর্শ ও অনুভূতির কথা মনে রাখা—এইসবই সম্পর্কের গভীরতার নিদর্শন।
কবিতার বিশেষ দিক হল, মানুষের অভিমান আর ভালোবাসার দ্বন্দ্ব যা প্রায়শই সম্পর্কের মধ্যে বিভ্রাট সৃষ্টি করে। মানুষ অভিমানে দূরে সরে যায়, কিন্তু তবু ভালোবাসা তাকে কাছাকাছি আসার আকাঙ্ক্ষায় রাখে। কবির ভাষায়, “মানুষ দুজনেই কেবল ভাবে, এসবই ওই মানুষটা করুক,” অর্থাৎ প্রত্যাশা থাকে অন্যজন যেন বেশি বেশি বোঝে, কিন্তু বাস্তবে কেউ সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না, যার ফলে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
কবিতাটি মানব জীবনের এক গভীর বাস্তবতা, যেখানে মনের সংকট, সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা, ভালোবাসার নিরলস আকাঙ্ক্ষা ও অভিমানের ছায়া মিলেমিশে একটি রঙিন কিন্তু সংকুচিত অনুভূতির জগত তৈরি করে। প্রতিটি লাইনে পাঠক নিজেকে খুঁজে পাবে, কখনো অভিমানী, কখনো প্রিয়জনের প্রতি অপেক্ষমান।
“মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী” কবিতাটি তাই শুধুমাত্র একটি অনুভূতিমূলক রচনা নয়, এটি সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব ও মানবিক সংবেদনশীলতার এক জীবন্ত দলিল। এটি পাঠককে ভাবায়, কীভাবে আমরা আমাদের কাছের মানুষকে বুঝতে পারি, কীভাবে আমাদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে মিলন ঘটানো যায়, আর কীভাবে অভিমান ও ভালোবাসার মধ্যে সেতুবন্ধন গড়া যায়।
কবিতার ভাষা সহজ, স্বচ্ছ ও হৃদয়গ্রাহী, যা মনকে মুগ্ধ করে, আবেগকে স্পর্শ করে এবং সম্পর্কের আন্তরিকতা উপলব্ধি করায়। এটি আমাদের শেখায়, ভালোবাসা শুধু কথায় নয়, ভালোবাসা হলো অনুভবে, বুঝে চলার মধ্যে, ছোট ছোট যত্নের মাঝেও।
এক কথায়, এই কবিতাটি মানব জীবনের সম্পর্কের সূক্ষ্মতা এবং অভিমানের মায়াজালকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। সাদাত হোসাইনের এই রচনা পড়ার পর প্রত্যেক পাঠক হয়তো তার নিজের জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠবে।
ফোকাস কিওয়ার্ড: মানুষ বড় অভিমানী প্রাণী, সাদাত হোসাইন কবিতা, মানুষের অনুভূতি, ভালোবাসার কবিতা, অভিমান ও সম্পর্ক