ভাল থেকো বাংলাদেশ – দীপেন ভুঁইয়া

মা!
খুব কষ্ট হচ্ছে৷
খুব যন্ত্রনা হচ্ছে মা৷

জানিনা আর কতক্ষন বেঁচে থাকব৷
সময় যে বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে৷
পর পর তিনটে লোহার বিন্দু
আমার বুকের ঠিক মাঝখান টায় আটকে আছে মা৷

বিশ্বাস করো, খুব কষ্ট হচ্ছে৷
শরীরের থেকেও মনের যন্ত্রনা টা বেশি হচ্ছে কেন মা
আজ?

মা আমার মৃতদেহ টা যখন তুমি পাবে,
যখন আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোব,
যখন আকাশে ঈদের চাঁদ উঠবে, যখন রথের দড়িতে
টান পড়বে…

মা তুমি ওদের বলে দিও, আমি ওদের ক্ষমা করেছি৷
মা আমি একটু একটু করে মারা যাচ্ছি মা৷
আমার জামাটা লাল রক্তে ভিজে গেছে৷
মা তুমি চিন্তা কোরনা৷

একটু পরেই শুকিয়ে যাবে৷
ভেজা জামায় আমার আর ঠান্ডা লাগবেনা মা৷
ঠান্ডা লাগার সময় যে আর নেই আমার কাছে৷

একটু, আর একটু অপেক্ষা কর মা,
আমি আসছি তোমার কাছে৷

মা জানো, আজ রফিকুল আমার জন্য অনেক খেজুর
এনেছিল৷
আর ওর মায়ের হাতের তৈরী লাচ্ছা৷
মা তোমার হাতের লুচিটা ওর হাতে এখনও আটকে
আছে৷
কেমন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখ আমার দিকে৷

মা,
ওর জন্য আর তোমাকে ঈদের জামা কিনতে হবে না৷
সামনের দূর্গাপূজায় আমার জামাটাও ভুলো ভিখিরি কে দিয়ে দিও৷

আমার আর নতুন জামা লাগবে না মা৷
আজ আমাদের অফিসটায় খুব আনন্দের দিন ছিল মা৷
আমরা সবাই খুশি ছিলাম৷ এমন সময় ওরা এল৷
কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে৷

একজন, দুজন তিনজন…আরও অনেকে৷
শান্তির দুত, ওদের হাতে কালো
চকচকে শান্তিরক্ষার হাতিয়ার৷
মা ওরা অনেকে ছিল৷ একই রকম৷ চিৎকার করে
বলে উঠল ‘হিন্দু কারা? দাঁড়িয়ে পড়’৷

আমি ভয় পেয়েছিলাম মা৷ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম৷
আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম৷

না মা, কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি৷
শান্তির তপ্ত সীসার দানা গুলো সব্বাইকে শুইয়ে দিয়েছিল৷
শুধু আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ আমার সামনে
তখন নিথর রফিকুলের তাৎক্ষনিক হিন্দু দেহটা৷
আমাকে আড়াল করেছিল মুসলমান ছেলেটা মা৷

তখনও আমি দাঁড়িয়েছিলাম৷
একটা দানা বুকে লাগার পর জিজ্ঞাসা করলাম ‘কি চাও?’
ওরা বলল ‘শান্তির ধর্ম রাষ্ট্র’৷

পাদুটো ভর করে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি৷
একটা যন্ত্রনা বুকের কাছটায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল৷
লাল রক্তটা ফিনকি দিয়ে আমার জামাটাকে ভিজিয়ে দিল মা৷

আরেকটা টুকরো বুকে ঢোকার পর বললাম ‘কিভাবে?’৷
ওরা বলল ‘তোদের শেষ করে, এদেশ থেকে তাড়িয়ে,
তারপর তোদের দেশে ঢুকে সেখান থেকে তাড়িয়ে’৷

ততক্ষনে কুচকুচে কালো একটা ধোঁয়া
ওঠা নল আমার বুকের চামড়া স্পর্শ করেছে৷

আরেকটা গরম স্পর্শ পেলাম হৃৎপিন্ডের দেওয়াল
ঘেঁসে৷ শেষবারের মত জিজ্ঞাসা করলাম ‘কেন?’৷
ওরা বলল ‘জিহাদ’৷

মা, জিহাদ মানে কি জানো? আমাদের মাষ্টারমশাই তো
শেখায়নি? আফশোষ রয়ে গেল মা, জিহাদের
মানেটা শিখে যেতে পারলামনা৷

ওর সিঁদুরটা মোছার সময় একটু পাশে থেকো মা,
হাতের চুড়িগুলো ভাঙ্গার সময় দেখো যেন
হাতে না লাগে৷ মা ওকে বোলো, আমি ওকে খুব
ভালবাসি৷ এখনও৷ আর দুমাস পরে যে আসবে তাকে
বোল, আমায় ক্ষমা করতে৷ হতভাগ্য বাপটাকে যেন
এখটুখানি ক্ষমা করে দেয়৷

মা?
তুমি কোথায় মা?
আমি একা হয়ে যাচ্ছি কেন মা?
চারদিক টা এত অন্ধকার হয়ে আসছে কেন মা?
তুমি কোথায় মা?

আমাকে কেন জন্ম দিয়েছিলে! জন্মই যদি দিলে
তবে কেন হিন্দু করলে?
কেন মুসলমান,খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ করলে মা?
কেন মানুষ করলেনা?

মা!
ওদের মায়েরাও কি ওদের মানুষ করতে পারেনি
মা?

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x