ভালোবাসি-সাদাত হোসাইন

ভালোবাসি – কবিতা | সাদাত হোসাইন

ভালোবাসি – কবিতা | সাদাত হোসাইন

“ভালোবাসি” কবিতাটি সাদাত হোসাইনের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা, যা আধুনিক প্রেমের একটি সুন্দর, রহস্যময় এবং হৃদয়স্পর্শী প্রকাশ। কবিতায় সাদাত হোসাইন প্রেম, দ্বিধা এবং সম্পর্কের গভীরতাকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতার পটভূমি এবং দুটি চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের নিরব, অদৃশ্য ভালোবাসা ফুটে উঠেছে, যা শুধুমাত্র তাদের মধ্যে থাকে, কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে তা অদৃশ্য থাকে।

কবিতার শুরুতেই একটি প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে গল্পের সূচনা হয়, যেখানে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে একে অপরকে ভালোবাসে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করে। তবে, তাদের মধ্যে এই অনুভূতি সরাসরি প্রকাশিত হয় না। তারা একে অপরকে প্রশ্ন করে, কিন্তু উত্তরে শুধুমাত্র নিরবতা থাকে। “আমায় ভালোবাসেন?” – এই প্রশ্নের সঙ্গেই শুরু হয় কবিতাটি। তারপরে, প্রশ্নের উত্তর “না” আসে, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে যা কখনও প্রকাশিত হয় না।

এখানে ছেলেটি একটি অন্যরকমভাবে সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এবং অবিশ্বাসী মনোভাব দেখায়, যখন সে মেয়েটিকে প্রশ্ন করে যে কেন সে প্রতিদিন ছাদে আসে। কিন্তু মেয়েটি তখন মুখ তুলে উত্তর দেয়, “সন্ধ্যার আকাশ আমার ভালো লাগে, কেমন লালচে হয়ে থাকে।” এটাই একেবারে প্রথম থেকে কবিতার মধ্যে গভীর প্রেমের প্রতিফলন এবং এটি তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি নিঃশব্দ বোঝাপড়া সৃষ্টি করে।

কবিতায় সাদাত হোসাইন তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে একটি দার্শনিক প্রশ্ন তোলেন – প্রেম কি শুধুমাত্র একটি অনুভূতির বিষয়, নাকি এটি প্রকাশিত হতে না চাইলেও তা সবার মাঝে একটি বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলে? কবিতায় ছেলেটি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে?” এবং মেয়েটি তার চোখের ইশারায় একটি অদৃশ্য প্রতিউত্তর দেয়। এটি এমন একটি মুহূর্ত, যেখানে অনুভূতির এক গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিন্তু তা কখনো বলা হয় না।

পরে, কবিতায় ছেলেটি তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, “আমারও আকাশ ভালোলাগে, বৃষ্টি ভালোলাগে, মেঘ ভালোলাগে।” তবে তার পরের কথাগুলি, “কিন্তু সেই আকাশ, মেঘ আর বৃষ্টি দেখবার সময় একজোড়া উৎসুক চোখও লাগে আমার,” সেখানে প্রেমের যে গভীরতা ও অস্পষ্টতা থাকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে সাদাত হোসাইন সম্পর্কের মধ্যে যে বিভ্রান্তি এবং দ্বিধার বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা প্রেমের অদৃশ্য শক্তি সম্পর্কে আমাদের আরও গভীর উপলব্ধি দেয়।

এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাদের বিপরীতে দুটো ছাদের রূপক অর্থ। ছেলেটি বলে, “কিন্তু ছাদ যে দুটো,” যা একসময় প্রেমের দ্বন্দ্ব এবং সম্পর্কের অস্থিরতাকে চিহ্নিত করে। কিন্তু শেষে যখন ছেলেটি বলে, “আকাশের মতন একটা ছাদ হতে পারে না? দুজন মানুষের একটা মাত্র ছাদ?” তখন এটি প্রেমের পূর্ণতা এবং সম্পর্কের সমন্বয়ের প্রতি একটি প্রগাঢ় প্রতিফলন।

এছাড়া, কবিতার মধ্যে একটি নিরব এবং গভীর অনুভূতির গঠন রয়েছে। প্রেমে কখনও কোনো সরাসরি কথা বা বিশেষ কোনো শব্দ ব্যবহার করা হয় না, বরং সম্পর্কের প্রতিটি পদক্ষেপ, এবং একে অপরের প্রতি অনুভূতির অভাবিত প্রকাশের মধ্যে একটি গভীর বোঝাপড়া তৈরি হয়। এই কবিতার মাধ্যমে সাদাত হোসাইন প্রেমের অস্পষ্টতা এবং দ্বিধার প্রতি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন, যেখানে প্রেমের কথা বলা ছাড়াই ভালোবাসা অনুভূত হতে পারে।

বহু বছর পর, কবিতার শেষ অংশে, তাদের মাথার ওপর একই ছাদ, ঠিক যেমন আকাশের মত একটাই ছাদ থাকে, সেভাবেই তাদের মধ্যে সেই একমাত্র সম্পর্কের প্রতিফলন থাকে। তারা কখনো “ভালোবাসি” শব্দটি উচ্চারণ না করলেও, তাদের সম্পর্ক এক অদৃশ্য বন্ধনে গড়ে ওঠে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রেম কখনো শব্দে প্রকাশিত হয় না, বরং এটি এক অনুভূতি যা সময়, স্থান এবং পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে চলে যায়।

এটি শুধুমাত্র একটি প্রেমের গল্প নয়, বরং একটি জীবনধারা, যেখানে সম্পর্কের ভিতরে চুপচাপ এক প্রগাঢ় ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। প্রেম কখনোই সরাসরি বলা হয় না, তবে এর অনুভূতি মাঝে মাঝে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কবিতার মাধ্যমে সাদাত হোসাইন সম্পর্কের সূক্ষ্মতা এবং প্রেমের অদৃশ্য, অনিশ্চিত প্রকৃতির প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

এটি প্রমাণ করে যে ভালোবাসা কখনো কোনো নির্দিষ্ট আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর অস্পষ্টতা, দ্বিধা এবং তন্ময়তা পাঠকদের মধ্যে প্রেমের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। পাঠক যখন এই কবিতাটি পড়ে, তখন তাদের মনের মধ্যে প্রেম এবং সম্পর্কের এক নতুন মাপকাঠি তৈরি হয়, যেখানে ভাষার অগ্রাধিকার থাকে না, বরং অনুভূতির পূর্ণতা প্রাধান্য পায়।

এই কবিতার মাধ্যমে সাদাত হোসাইন প্রেমের স্বাভাবিকতা এবং সম্পর্কের জটিলতাকে এক গভীর দৃষ্টিতে আনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে সম্পর্কের মধ্যে কি ঘটছে তা ভেতরে অনুভূত হয়, কিন্তু কখনো সরাসরি বলা হয় না। “ভালোবাসি” শব্দটি উচ্চারণ করা না হলেও, সেই অনুভূতি ঠিকই জীবনের মধ্যে পূর্ণতা পায়।

কবির এই অবাক করা সূক্ষ্মতা, এবং সম্পর্কের মধ্যে সেই গভীর অদৃশ্য বন্ধন, যা দুজন মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসে, তা আমাদের চিরকাল মনে রাখার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। সাদাত হোসাইন খুবই সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন যে, প্রেম কখনো সরাসরি না বললেও, এর অনুভূতি এবং তার প্রকাশ কখনোই অদৃশ্য থাকে না।

  • আমায় ভালোবাসেন?
  • না।
  • তাহলে?
  • তাহলে কিছুই না!
  • কিন্তু রোজ বিকেলে, সন্ধ্যার আগে আগে ঠিক এমন সময়ে ছাদে আসেন যে?
  • কীভাবে জানেন?
  • কীভাবে আবার? আমাদের ছাদ থেকে ঠিক দেখা যায়!
  • রোজ?
  • হু।
  • তার মানে আপনিও রোজ আসেন?
  • হু, আসি।
  • তাহলে কি আপনিও আমায় ভালোবাসেন?

মেয়েটা সাথে সাথে জবাব দেয় না। মাথা নামিয়ে নেয়।
অনেকক্ষণ। নিজেকে সামলে নেয় বোধহয়।
তারপর চকিতে মুখ তুলে সে বলে, ‘সন্ধ্যার আকাশ আমার ভালো লাগে,
কেমন লালচে হয়ে থাকে। ওটা দেখতে আসি’।

-‘কিন্তু গত দু’দিন ধরে আকাশে লাল রঙ নেই। মেঘলা আকাশ। গুমোট। বৃষ্টি’।

  • ‘আমার মেঘলা আকাশও ভালো লাগে।’
  • ‘ওহ’।
  • ‘ বৃষ্টিও’।
  • ‘আচ্ছা! যাই তাহলে?’ ছেলেটা বলে।

মেয়েটা চুপ করে থাকে। কথা বলে না। নাকি বলে? চোখে!
ছেলেটা ঘাড় ঘুড়িয়ে খানিক তাকায়। খানিক দ্বিধা। তারপর ফিরে চলে।

মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে।
ছেলেটা চায়ের দোকান পেরিয়ে সরু গলির ভেতর ঢুকে পড়ে।
মেয়েটা দাঁড়িয়েই থাকে। দাঁড়িয়েই থাকে।
যেন নির্নিমেষ অপেক্ষার নিশ্চিন্ত প্রহর। তারপর? ছেলেটা ফিরে আসে।

মেয়েটা জানত?

ছেলেটা বলে, ‘আমারও আকাশ ভালোলাগে, বৃষ্টি ভালোলাগে, মেঘ ভালোলাগে। কিন্তু…’

  • ‘কিন্তু কী?’
  • ‘কিন্তু সেই আকাশ, মেঘ আর বৃষ্টি দেখবার সময় একজোড়া উৎসুক চোখও লাগে আমার’
    -‘কোথায়?’

ছেলেটা থমকায়। ভাবে। তারপর বলে, ‘ছাদের ওপাশে’। তার কণ্ঠে দ্বিধা
মেয়েটা হাসে, ‘শুধুই ছাদের ওপাশে?’
ছেলেটা জবাব দেয় না। জুতোর আগায় মেঝেতে অর্ধবৃত্ত আঁকে!
মেয়েটা বলে, ‘দুটো ছাদের আকাশতো একটাই’।
ছেলেটা বলে, ‘কিন্তু ছাদ যে দুটো’।
মেয়েটা বলে, ‘তাহলে?’

ছেলেটা বলে, ‘আকাশের মতন একটা ছাদ হতে পারে না?
দুজন মানুষের একটা মাত্র ছাদ?’

মেয়েটা হাসে, ছেলেটাও।

বহু বছর বাদে তাদের মাথার ওপর ওই একটা মাত্র আকাশের মতন একটা ছাদই থাকে।
অথচ, তারা কেউ বলে নি, ‘ভালোবাসি’!

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x