কবিতার খাতা
পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত – অসীম সাহা।
কাল রাতে ওরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ-সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছে
আমাকে ওরা এক নিঃসঙ্গ অন্ধকার রাতের থমথম নিস্তব্ধতার মধ্যে
বেঁধে রেখে বলেছে, ‘শাট-আপ। কথা বললেই গুলি করবো।’
তখনই সমস্ত পৃথিবী কাঁপিয়ে, সমস্ত চরাচর, বনভূমি কাঁপিয়ে
একটা ভয়ানক হাহাকার, মৃতদের কলরোল উড়ে এসে
আমার বুকের কাছে আছড়ে পড়েছে আমি কেঁপে উঠেছি।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার মায়ের মুখ
একটি নিঃসঙ্গ একাকী প্রদীপের নিচে বেদনায় নুয়ে থাকা
আমার জন্মদাত্রীর এলায়িত দেহের ভঙ্গিমা
চৌকাঠে এলোমেলো বাতাসের আঘাতে উদাসীন
আমার প্রিয়তমা, আমার সন্তান, আমার একমাত্র উত্তরাধিকার।
এইসব ভাবতে-ভাবতে আমার রক্তের ভেতরে জেগে উঠেছে
এক পরাজিত সৈনিকের আহত, ক্ষতবিক্ষত, ক্লান্ত-দেহের অস্বাভাবিক স্থবিরতা।
অথচ আমাকে থামলে চলবে না।
আমার সামনে কোটি-কোটি মানুষের গগনবিদারী চিৎকার
আমার সামনে বিস্তৃত দিগন্তের নিচে অনাবিল সবুজ ধানের খেত
আমার সামনে পাকা ধানের মতো জীবনের
অবিরত সম্ভাবনার সোনালি ভাঁড়ার
আমার চোখে জল নেমে আসে।
আমি অনেকদিন অসম্ভব বৃষ্টির বিপুল জ্যোৎস্নার মধ্যে
শিশুর মতো খেলতে পারিনি
দুরন্ত বলের মতো সহস্র স্বপ্নের মধ্যে আমার নিবিড় প্রেম
অশ্ব হয়ে ছুটতে পারেনি কোনোদিকে
শুধু রক্তলাল এ-জীবন বহতা নদীর মতো
প্রয়োজনে ছুটে গেছে দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে।
বুকের ভেতরে জেগে উঠেছে শতাব্দীর নীল আর্তনাদ
জেগে উঠেছে শোষণের সহস্র কাহিনী
শৃঙ্খলিত জীবনের মর্মঘাতী অতীত যাতনা।
সাথে-সাথে আমার শিথিল হাত
জড়াতে-জড়াতে মুষ্টিবদ্ধ ইস্পাতে পরিণত হয়েছে
আমার কম্পিত করতলে ঘেমে উঠেছে শতাব্দী-লাঞ্ছিত মানুষের
এক অসম্ভব উজ্জ্বল রাসায়নিক বাল্ব।
আমি এক্ষুনি আমার বাল্ব ছুঁড়ে দেবো
আজ কোনো পরিত্রাণ নেই
কাল রাতে তোমরা আমার দেহ থেকে
সিরিঞ্জ-সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছো
আজ তার প্রতিশোধ
এক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে তোমাদের এক-একটা জীবনকে
আমি আমার স্বপ্নের আঘাতে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দেবো।
আমার বুকের ভেতরে এক নিঃসংশয় নগরীর প্রজ্বলিত আভা
আমার বুকের ভেতরে একটি সমান পৃথিবীর সবুজ মানচিত্র
আমি এখন ইচ্ছে করলেই সমস্ত পৃথিবীকে
আমার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি,
শুধু প্রয়োজন প্রতিটি ঐতিহাসিক রক্তবিন্দুর কাছ থেকে
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জেনে নেয়া
আমি সেই রক্তবিন্দু কাছ থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি
নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই
আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্যে
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত করে যেতে চাই।
আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। অসীম সাহা।