দুঃখ – শামসুর রাহমান।

আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম।

ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।
আমাদের একরত্তি উঠোনের কোণে
উড়ে-আসা চৈত্রের পাতায়
পাণ্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়
গ্রীষ্মের দুপুরে ঢকঢক্
জল-খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত-ঠকঠক
রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে নাম
অবিরাম।

পিরিচ চামচ আর চায়ের বাটিতে
রোদ্দুরের উল্কি-আঁকা উঠোনের আপন মাটিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।

চৌকি, পিঁড়ি শতরঞ্জি চাদর মশারি
পাঞ্জাবি তোয়ালে লাল
কস্তাপেড়ে শাড়ি
প্রখর কম্বল আর কাঁথায় বালিশে
ঝাপসা তেলের শিশি টুথব্রাশ বাতের মালিশে
দুঃখ তার লেখে নাম।

খুকির পুতুলরানী এবং খোকার পোষমানা
পাখিটার ডানা
মুখ-বুজে-থাকা
সহধর্মিণীর সাদা শাড়ির আঁচলে দুঃখ তার ওড়ায় পতাকা।
পায়ে-পায়ে-ঘোরা পুষি-বেড়ালের মসৃণ শরীরে
ছাগলের খুঁটি আর স্বপ্নের জোনাকিদের ভিড়ে
বৃষ্টি-ভেজা নিবন্ত উনুনে আর
পুরানো বাড়ির
রাত্রিমাখা গন্ধে আর উপোসী হাঁড়ির
শূন্যতায় দুঃখ তার লেখে নাম।

হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃততম গানে
সুখের নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে,
অধরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের
মধ্যদিনে
আমার নৈঃশব্দ আর মুখর আলাপে
স্বাস্থ্যের কৌলিন্যে ক্রূর যন্ত্রণার
অসুস্থ প্রলাপে,
বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ম সঙ্গিনে
দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায়
আসক্তির কানায় কানায়
বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে
দুঃখ তার লেখে নাম।

রৌদ্রঝলকিত ভাঙা স্তিমিত আয়নায়
নববর্ষে খুকির বায়নায়
আমার রোদ্দুর আর আমার ছায়ায়
দুঃখ তার লেখে নাম।

অবেলায় পাতে-দেয়া ঠাণ্ডা ভাতে
বাল্যশিক্ষা ব্যাকরণ এবং আদর্শ
ধারাপাতে
ফুলদানি, বিকৃত স্লেটের শান্ত
মেঘলা ললাটে
আর আদিরসাত্মক বইয়ের মলাটে
চুলের বুরুশে চিরুনির নম্র দাঁতে
দুঃখ তার লেখে নাম।

কপালের টিপে, শয্যার প্রবাল দ্বীপে,
জুতোর গুহায় আর দুধের বাটির সরোবরে
বাসনার মণিকণ্ঠ পাখিডাকা চরে
দুঃখ তার লেখে নাম।

বুকের পাঁজর ফুসফুস আমার পাকস্থলিতে
প্লীহায় যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।

আমার হৃৎপিণ্ডে শুনি
দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক্ দ্রাক্
দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক।
ঐ জীমরতিভরা পিতামহ ঘড়ির কাঁটায়
বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি,
পানের বাটায়
গোটানো আস্তিনে দুমড়ানো পাৎলুনে
কাগজের নৌকা আর রঙিন বেলুনে
দুঃখ তার লেখে নাম।

কখনো না-দেখা নীল দূর আকাশের
মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়
হৃদয়ের নিভৃত ভাষায়
দুঃখ তার লেখে নাম।

আরো কবিতা পড়তে ক্লিক করুন। শামসুর রাহমান।

দুঃখ – শামসুর রাহমান | বাংলা কবিতা বিশ্লেষণ

শামসুর রাহমান রচিত “দুঃখ” বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী ও দার্শনিক কবিতা, যেখানে কবি মানব জীবনের সর্বত্র বিরাজিত দুঃখকে অত্যন্ত শিল্পিতভাবে চিত্রিত করেছেন। কবিতাটির প্রথম লাইন “আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে দুঃখ তার লেখে নাম” পাঠককে সাথে সাথেই এক গভীর মেলাঞ্চলিক ও দার্শনিক অভিজ্ঞতার জগতে নিয়ে যায়।

কবিতার সারাংশ

এই কবিতায় কবি দুঃখকে একটি সর্বব্যাপী ও সক্রিয় সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বস্তুতে এবং প্রতিটি মুহূর্তে তার উপস্থিতি লিপিবদ্ধ করে। কবি দেখিয়েছেন কীভাবে দুঃখ শুধু মানসিক অনুভূতি নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বস্তু, সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কবিতাটিতে রয়েছে গৃহস্থালির সাধারণ বস্তু থেকে শুরু করে গভীর মানসিক অনুভূতি পর্যন্ত দুঃখের ব্যাপক বিস্তারের মর্মস্পর্শী বর্ণনা।

রূপক বিশ্লেষণ

কবিতায় “দুঃখ”কে একটি সক্রিয় লেখক ও শিল্পী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা সর্বত্র তার “নাম লেখে” – এটি একটি শক্তিশালী রূপক যে দুঃখ মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য ও সক্রিয় অংশ। “ঢাক বাজানো” হৃদয়ের স্পন্দন এবং জীবনের ছন্দের প্রতীক। “নিবন্ত উনুন” নিষ্প্রাণ আশা ও নির্বাপিত উদ্দীপনার প্রতীক। “উপোসী হাঁড়ি” অভাব ও শূন্যতার প্রতীক।

প্রধান রূপকসমূহ

দুঃখ – জীবনের অস্তিত্বমূলক reality এর প্রতীক; নাম লেখা – অস্তিত্বের ছাপ রাখার প্রতীক; ঢাক – হৃদয়স্পন্দন ও জীবনের ছন্দের প্রতীক; নিবন্ত উনুন – নির্বাপিত আশার প্রতীক; উপোসী হাঁড়ি – শূন্যতা ও অভাবের প্রতীক; বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি – সময়ের গতি ও বৃদ্ধাবস্থার প্রতীক।

কবির উদ্দেশ্য ও সাহিত্যধারা

শামসুর রাহমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, যিনি তার গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পিত অভিব্যক্তির জন্য পরিচিত। এই কবিতায় তার উদ্দেশ্য ছিল মানব জীবনে দুঃখের সার্বজনীনতা এবং এর গভীরতা তুলে ধরা। এটি দার্শনিক কবিতা এবং অস্তিত্ববাদী কবিতার মিশ্র ধারায় রচিত, যেখানে কবি জীবনের মৌলিক সত্যকে explore করেছেন।

আবেগ বিশ্লেষণ

কবিতায় গভীর মেলাঞ্চলি, অস্তিত্ববাদী বেদনা, এবং জীবনের প্রতি এক ধরনের গভীর উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে। কবির ভাষায় “আমার হৃৎপিণ্ডে শুনি দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক্ দ্রাক্ দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক” – এই লাইনের মধ্যে যে হৃদয়স্পন্দন এবং জীবনের ছন্দের সাথে দুঃখের সম্পর্ক ফুটে উঠেছে, তা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। কবির বর্ণনায় দুঃখ শুধু negative emotion নয়, বরং এটি জীবনের একটি organic এবং integral part।

কবিতার কাঠামো বিশ্লেষণ

কবিতাটি মুক্ত ছন্দে রচিত, যেখানে repetitive structure (“দুঃখ তার লেখে নাম”) একটি musical refrain এর মতো কাজ করে। কবিতার গঠনশৈলীতে রয়েছে concrete objects থেকে abstract ideas এ progression, যা কবিতাকে বিশেষ depth দিয়েছে।

শৈলীগত বৈশিষ্ট্য

কবি highly evocative এবং sensory language ব্যবহার করেছেন। তাঁর শব্দচয়নে রয়েছে uncommon poetic density এবং philosophical depth। everyday objects কে poetic symbols এ রূপান্তর করার ক্ষেত্রে কবির skill exceptional।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

এই কবিতায় বাংলার middle-class household life এবং তার cultural specifics এর ছোঁয়া রয়েছে। কবি Bangladeshi urban life এর details কে universal human condition এর metaphor হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি show করেছেন কীভাবে cultural specifics এর মধ্য দিয়ে universal truths কে express করা যায়।

শিক্ষণীয় দিক

কবিতাটি পাঠককে শেখায় যে দুঃখ জীবনের একটি অনিবার্য এবং সার্বজনীন অংশ, এবং এটিকে accept করা এবং understand করা জীবনের一个重要 aspect। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে দুঃখ শুধু negative নয়, বরং এটি human experience এর completeness এর জন্য প্রয়োজনীয়।

মেটা ডেসক্রিপশন

শামসুর রাহমানের “দুঃখ” কবিতার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ। কবিতার রূপক, ছন্দ, শৈলী ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গভীর আলোচনা। প্রথম লাইন “আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে দুঃখ তার লেখে নাম” সহ সমগ্র কবিতার ব্যাখ্যা।

FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)

কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু কী?

কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু হলো মানব জীবনে দুঃখের সার্বজনীনতা এবং সর্বব্যাপীত্ব। কবি দেখিয়েছেন যে দুঃখ শুধু একটি মানসিক অবস্থা নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি aspect এ woven into the fabric of our existence।

কবিতার প্রধান রূপকগুলি কী কী?

প্রধান রূপকগুলি হলো: দুঃখ, নাম লেখা, ঢাক, নিবন্ত উনুন, উপোসী হাঁড়ি, এবং বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি – যারাそれぞれ বিভিন্ন দার্শনিক ও অস্তিত্ববাদী বিষয়ের প্রতীক।

শামসুর রাহমানের কবিতার বৈশিষ্ট্য কী?

শামসুর রাহমানের কবিতায় সাধারণত গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, শিল্পিত ভাষা, এবং human condition এর nuanced understanding এর প্রকাশ ঘটে। তাঁর ভাষায় lyrical quality এবং philosophical depth এর uncommon combination দেখা যায়।

কবিতাটির প্রথম লাইন কী?

কবিতাটির প্রথম লাইন: “আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে দুঃখ তার লেখে নাম” যা সরাসরি পাঠককে কবিতার মূল theme এবং stylistic approach এ নিয়ে যায়।

কবিতাটি কোন ধারার অন্তর্গত?

কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার দার্শনিক ধারা এবং অস্তিত্ববাদী কবিতার অন্তর্গত, যেখানে কবি human condition এর মৌলিক truths কে explore করেছেন।

কবিতাটির বিশেষত্ব কী?

কবিতাটির বিশেষত্ব হলো এর comprehensive exploration of sorrow এবং everyday objects কে philosophical symbols এ রূপান্তর করার skill। কবিতাটি shows how the personal becomes universal through poetic expression।

কবিতাটির শেষের দিকের লাইনগুলোর তাৎপর্য কী?

কবিতাটির শেষের দিকের লাইনগুলো “হৃদয়ের নিভৃত ভাষায় দুঃখ তার লেখে নাম” – এই লাইনের মাধ্যমে কবি দেখিয়েছেন যে দুঃখ শুধু বাহ্যিক objects এ নয়, বরং আমাদের most intimate thoughts এবং hopes এর মধ্যেও তার presence লিপিবদ্ধ করে।

© Kobitarkhata.com – কবি: শামসুর রাহমান

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x